চেয়ারম্যানের নাতনী

চেয়ারম্যানের নাতনী

হঠৎ চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল সাইদার। এটা কিসের চেঁচামেচি, কেন এত আওয়াজ? কোত্থেকে আসছে? একটু বুঝার চেষ্টা করল সে। বুঝতে পারলো এটা মানুষের আওয়াজ, অনেক মানুষের ভীড় জমেছে। কিন্তু রাত-দুপুরে কেন এত মানুষ? কেনইবা এত চেচাঁমেচি? কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না সাইদা। ভাবলো পাশে শুয়ে থাকা খালামণিকে জিজ্ঞেস করি। হাত বাড়াতেই বিছানা খালি, খালামণি সেখানে নেই। হয়তোবা চেচাঁমেচির আওয়াজ পেয়ে আগেই উঠে বাইরে গেছে খালামণি।

সাইদা উঠে বসলো বিছানায়, হাত বাড়িয়ে বেডসুইচ অন করতেই এনার্জি বাল্বটি জ্বলে ওঠলো। নিকষ কালো অন্ধকার দূরীভূত হয়ে আলোকিত হলো কামরা। ফকফকা হয়ে উঠলো পুরো ঘর। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো সাইদা। রাত তখন ২টা ৫৫ মিনিট, তিনটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। সে ভাবলো খালামনি তাহাজ্জুতে আছেন। কিন্তু না, ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো সাইদা। তার বয়স তখন এগারো বছর। চঞ্চলমনা একদুরন্ত কিশোরী। বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় থাকে। বাবা বার্ডেম হাসপাতালের ডাক্তার। সে তখন পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা শেষে মামারসাথে নানাবাড়িতে বেড়াতে এসেছে।

দেশ-গ্রাম দেখতে, দিগন্ত জোড়া ফুল-ফল, ফসলের মাঠ আর কৃষকদের দেখতে। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শহরের মানুষের জন্য চাল, ডাল ও সবজি ফলায়। তার অনেক দিনের সখ, নানার দীঘিতে মাছ ধরবে আর গ্রামের মেয়েদের সাথে কানামাছি-বৌছি খেলবে। তাইতো সে আজ সকালে খালামণির সাথে পুরোগ্রাম চষে বেড়িয়েছে। গ্রামের মানুষ দেখেছে। গ্রামের ঘর-বাড়ি, মাঠ-ঘাট, গাছপালা সবই দেখেছে, মেঠো পথের আইল দিয়ে দীর্ঘক্ষণ হেঁটেছে। দীর্ঘক্ষণ দীঘীর পাড়ে বসে বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরেছে। সবকিছু সে প্রাণভরে উপভোগ করেছে। বেশি ভালো লেগেছে দীঘীর পাড়ে বসে কচুরি ফুল দেখতে। অপরূপ এই দৃশ্য দারুনভাবে তার কচিমনকে আন্দোলিত করেছে।

খালামণি তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে গ্রামের অনেকের সাথে। খালামণি তার থেকে পাঁচ বছরের বড়। এলাকার চেয়ারম্যানের ছোট মেয়ে হওয়ায় সবাই তাকে চেনে। স্নেহ করে, ভালবাসে। আর সাইদা হলো চেয়ারম্যানের নাতনী। ঢাকার রানী, তাই সবাই তাকে আদর করে, স্নেহ করে ভালোবাসে রাজধানীর গল্প শুনতে চায়। গ্রাম কেমন লাগছে? ইত্যাদি জানতে চায়। তার সাথে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করে অনেকেই। তাকে পেয়ে গ্রামের সবাই খুব খুশি।

সাইদা বাইরে বের হওয়ার আগেই ঘরে ঢুকলো তার খালামণি। তাকে বললো আম্মু! চোর দেখবে, চোর? মুরগী চোর। চোর ধরে উঠানের আমগাছে ঝুলিয়ে পেটানো হচ্ছে। একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো খালামণি। তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস-আনন্দ। সাইদা কোনদিন চোর দেখেনি, চোরের কথা শুধু বইয়ে পড়েছে। আজকে সে চোর দেখবে ভাবতেই তার মন আনন্দে নেচে উঠলো। খালামণির হাত ধরে বাইরে এলো সে। দেখলো, এই রাতদুপুরে গ্রামের নারী-পুরুষ চোর দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে চেয়ারম্যানের বাড়ির উঠানে। মানুষের ভীড় ঠেলে এসে সাইদা দেখলো, একজন লোকের হাতে রশি বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে। দু’জন তাকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। লোকটি মারের চোটে বাবারে! মারে! বলে চিৎকার করছে। আর কতোগুলো লোক বিভিন্ন কথা বলে পেটানোর জন্য আরো উৎসাহ দিচ্ছে। তার নানাভাই চেয়ারে বসে আছেন তার পাশে আরো নেতা গোছের কয়েকজন বসে পান-বিড়ি খাচ্ছেন। লোকটিকে এভাবে পেটানোর জন্য তারাই মনে হয় হুকুম দিয়েছে।

সাইদা ভাবছে, একি হচ্ছে! দেখতে এলাম চোর, দেখছি মানুষ! এই লোকটিও তো আমাদের মতোই মানুষ। তাহলে চোর হবে কেন? একজন মানুষকে মানুষেরা কেন চোর বলছে? এত নিষ্ঠুরভাবে কেন পেটানো হচ্ছে? এরকম হাজারও প্রশ্ন এসে তার কচি মনে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করছে। ব্যথায় তার বিবেকের টনক নড়ে উঠলো। দু’চোখের কোণ ভিজে এলো। রক্তিম দু’কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। ইতোমধ্যে দেখলো তার মতো দশবছরের একটি কিশোরী এসে হাউমাউ করে বলছে, তোমরা মোর বাপকে মেরো না, মোর বাপ চোর না। মোর বাপকে এভাবে মারিলে মোর বাপ মরে যাবে।

আর নিরব থাকতে পারলো না সাইদা। সাহসী নারীর মত গর্জে উঠলো। থামুন আপনারা! এভাবে একজন মানুষকে ঝুলিয়ে পেটানো হচ্ছে কেনো? পেটানো বন্ধ করুন। তাকে গাছ থেকে নামিয়ে হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিন। উপস্থিত গ্রামের মানুষদের লক্ষ্য করে বললো, আপনার কেমন মানুষ! একজন মানুষকে গাছে ঝুলিয়ে পেটানো হচ্ছে, আর আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছেন!

এুহূর্তেই তার গর্জনে নিরব হয়ে গেলো হট্টগোল। যে দু’জন চৌকিদার লোকটিকে পেটাচ্ছিলো তারাও পেটানো বন্ধ করলো। চেয়ারম্যান সাহেব নির্দেশ দিলেন, নামিয়ে আনো তাকে; বাঁধন খুলে দাও। হাত পায়ের বাঁধন খুলতেই দশবছরের মেয়েটি এসে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো।
এখন সবাই নিরব। সাইদা লোকটির কাছে এগিয়ে গোলো। মাথায় হাত রেখে বলল- আংকেল কাঁদবেন না। মানুষেরা আপনাকে চোর বলছে কেন? আপনি তো মানুষ। মানুষেরা আপনাকে চোর বলছে, এটা ঠিক না।
এবার লোকটি সাইদাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো- মা! তুমি ঠিকই বলেছো, আমি চোর না। কিন্তু আজকে আমি চুরি করতে গিয়েছিলাম। চুরি করতে পারিনি। তার আগেই ধরা পড়ে গেছি, বলে লোকটি আবারও কেঁদে লাগলো।

কিন্তু আংকেল আপনি আজকে চুরি করতে গেলেন কেনো? জিজ্ঞেস করলো সাইদা।
লোকটি নিরব, কোন কিছুই বলছে না। সাইদা বুঝতে পারলো, কোন এক অব্যক্ত বেদনা লোকটিকে অক্টোপাশের মতো বেঁধে রেখেছে। সাইদা বললো- আমি আপনার মেয়ের মত, আংকেল আপনি চুপ করে থাকবেন না। আমাকে খুলে বলুন কেন আপনি চুরি করতে গেলেন?

এবার নিরবতা ভাঙলো লোকটি। সে বললো- আমি রেল স্টেশনে কুলির কাজ করি। করোনা ভাইরাসের কারণে কোন কাজ পাচ্ছি না। বাড়িতে যা খাবার ছিলো দু’দিন আগে শেষ হয়ে গেছে। দু’দিন আমরা না খেয়ে আছি। আমার ছোট ছোট মেয়ে দু’টি শুধু পানি খেয়ে আছে। কোন খাবার দিতে পারিনি তাদের মুখে, বলেই লোকটি আর তার মেয়ে একসাথে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো।

এবার অশ্রু ধরে রাখতে পারলো না সাইদা। তার কচি দু’গাল বেয়ে বেড়িয়ে আসতে লাগলো কষ্টসিক্ত অশ্রু। নানাভাই এগিয়ে এসে অশ্রু মুছে দিলো সাইদার। এবার সে নানাভাইকে বললো- নানাভাই তুমি কি খলিফা উমরের নাম শুনেছো? আব্বু আমাকে তার দেশ পরিচালনার কাহিনী শুনিয়েছেন। তিনি ছিলেন অর্ধেক পৃথীবির শাসক। তারপরও রাত্রে ঘুমাতেন না তিনি। ঘুরে ঘুরে দেশের মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন। কে অনাহারে-অর্ধহারে রাত কাটাচ্ছে তাঁর রাজ্যে। নিজের কাঁধে আটার বস্তা নিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের দ্বারে-দ্বারে যেতেন। আর বলতেন আমার রাজ্যে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তাহলে এর জবাবদিহিতা উমরকে করতে হবে।

নানাভাই তুমি তো অর্ধ পৃথীবির রাজা নও, একটি দেশের রাজা নও, একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাত্র। তুমি কি পারো না খলিফা উমরের মত করে তোমার ইউনিয়নটি পরিচালনা করতে? তুমি কি একটি ইউনিয়নের মানুষের সুখ-দুঃখের খবর নিতে পারো না? তুমি কি পারো না রাত্রিবেলা না হোক অন্ততঃ দিনেরবেলা মানুষের বাড়ি বাড়ি খোঁজ খবর নিতে? ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে? অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে? তুমি যদি এসব করতে না পারো, তাহলে কেন এদের দায়িত্ব নিতে গেলে? বলো নানাভাই বলো! চুপকরে থেকো না। বলে বসে পড়লো সাইদা।

নিস্তব্ধ হয়ে গেলো পুরো মজলিস। কেউ কোনো কথা বলছে না, সাইদার কথাগুলো উপস্থিত সকলের বিবেককে যেন হাতুড়ী দিয়ে পেটাতে লাগলো। বিশেষ করে সাইদার নানা, চেয়ারম্যান সাহেবের বিবেককে। তার মস্তক অবনত হলো, তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি আস্তে আস্তে মাথা তুললেন, চোখ-মুখ ছলছল করছে। চেয়ারম্যানের চেয়ার যেন আজ কষ্টের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জড়িয়ে ধরলেন নাতনীকে। কেঁদে কেঁদে কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেন, আপু আমি আমার দায়িত্ব ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি আমার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছো, আমার ভুল সুধরে দিয়েছো। আমি অন্ধকারে ছিলাম, তুমি আলো জ্বেলেছো, আলোর পথ দেখিয়েছো। তোমাকে ধ্যবাদ! তোমাকে স্যালুট!

এবার চেয়ারম্যান সাহেব উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন- ভাইয়েরা আমি আপনাদের আমানত খেয়ানত করেছি, দায়িত্বের অবহেলা করেছি; আপনাদের প্রাপ্য অধিকার ক্ষুণ্ন করেছি। আমি আপনাদের নিকট ক্ষমা চাচ্ছি, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। আমি কথা দিচ্ছি, আমাদের এই ইউনিয়নকে খলিফা উমরের মত করে পরিচালনা করবো, ইনশাআল্লাহ। আপনারা আমার নাতনীটুকুর জন্য দোয়া করবেন। দশবছরের মেয়েটি তখন শ্লোগান দিলো ‘চেয়ারম্যানের নাতনী’! সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment