স্কুলে একদিন -এনায়েত রসুল

স্কুলে একদিন -এনায়েত রসুল

স্কুলে একদিন
এনায়েত রসুল

আমার নাম অধরা। এই যে মাত্র এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেল, আমিও সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। ইনশাআল্লাহ ভালো রেজাল্ট করে বাবা-মা আর স্যার-আপুদের যে খুশি করতে পারবো, সে বিশ্বাস আমার আছে। আর আছে স্কুলের সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট।
জানি না অন্যদের কেমন লাগছে। আমার সঙ্গে যারা এই স্কুল ছেড়ে যাবে, বা অন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী যারা পরীক্ষায় পাস করে কলেজে ভর্তি হবে, তাদেরও কি আমার মতোই লাগছে? আমার খুব খারাপ লাগছে। সত্যি করে বলছি, আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে, কোনোদিন যদি স্কুল ছেড়ে যেতে না হতো, তাহলে খুব ভালো হতো আমার জন্য। আহা রে, যখন মনে পড়ে রেজাল্ট আউট হওয়ার পর আমার দশ বছরের বন্ধুগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, রোজ রোজ আর দেখা হবে না, তখন বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। কান্না এসে চোখ দুটোকে ঝাপসা করে দেয়। বন্ধুহীন হয়ে যাওয়ায় আতঙ্কে আমি সাররাত কাঁদি- শুধুই কাঁদি।
মা বলেন, এসব ভেবে মন খারাপ করিস না। পুরোনো বন্ধুদের জন্য কয়েক দিন মন খারাপ লাগবে। এ সময়ের ভেতর নতুন বন্ধুরা এসে তোর মনের কোণে জেঁকে বসবে। তারপর মন থেকে সব দুঃখ মুছে যাবে। পুরোনোকে ভুলে নতুনকে আপন করে নেয়ার নামই জীবন।
জীবন কাকে বলে আমি তা বুঝি না। বুঝতে চাইও না। আমি শুধু বুঝি, নতুনকে পেয়ে আমি পুরোনোকে ভুলে যেতে চাই না। নতুন যেমন আমার জীবনে আসবে- পুরোনোও তেমন থাকবে নতুন পাশাপাশি। কিন্তু জীবনের নিয়ম তো আমার কথা শুনবে না। আমার জন্য থেমেও থাকবে না। না চাইলেও আমাকে হয়তো নতুনকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে- সেখানেই আমার ভয়।
কেমন করে আমি এতোদিনকার পরিচিত স্কুলভবন, বকুলতলা, ইমরান চাচার ঘণ্টা বাজানো আর ক্লাসের বন্ধুদের ভুলে নতুন করে সব শুরু করবো? শুরু আমাকে করতেই হবে- এ কথাটা মনে হতেই নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়।
এতোদিন ধরে আমার ডান পাশে নীতা আর বাঁ পাশে বিশাখা এসে বসতো। সেই ক্লাস ফাইভ থেকে আমরা একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে এসেছি। গল্প করেছি, ঝগড়া করেছি আবার বন্ধু হয়ে গেছি। আবার পাশাপাশি বসেছি।
বিশাখা খুব কেঁদেছে শেষ পরীক্ষার দিন। কারণ, ও নাকি চট্টগ্রাম গিয়ে এ্যাডমিশন নেবে। আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনো চান্সই থাকবে না। নীতা অবশ্য ঢাকাতেই থাকবে। তবে কোন্ কলেজে পড়াশোনা করবে, তা এখনো ঠিক করেনি। আর আমি তো স্কুল ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারছি না, কলেজের ভাবনা তো পরের কথা।
কতো কথা মনে পড়ছে আজ! শুধু বন্ধুদের কথাই নয়, স্যার আর আপুমণিদের কথাও মনে পড়ছে।
প্রত্যেক স্কুলেই এমন দু-একজন শিক্ষক থাকেন যারা মনে করেন শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় যেমন তুখোড় হবে-আচার-ব্যবহারেও তেমন মার্জিত হবে। সবার মাঝে যে সব গুণ একসঙ্গে পাওয়া সম্ভব নয়, এ সত্যটি তারা মেনে নিতে চান না। শুধু বলেন, ‘লেখাপড়ায় ভালো হলেই চলবে না। আচার-আচরণেও তোমাকে ভালো হতে হবে।’ আবার কোনো কোনো শিক্ষক বলেন, ‘খেলাধুলাতে তো হেলেনা উইলিয়াম্স হয়ে আছো। পড়ালেখাতেও তোমাকে বিদ্যাসাগর হতে হবে।’ একেবারে উল্টো চাওয়া!
আমাদের বাংলা পড়ান সাজিদ স্যার- সাজিদুর রহমান। তার কণ্ঠস্বর ভরাট আর উচ্চারণ স্পষ্ট। সেই স্যার বলেন, শিক্ষক হিসেবে কামনা করি, আমার ছাত্রীরা মেধাবী হবে। গর্ব করার মতো রেজাল্ট করবে। কিন্তু পিতা হিসেবে, তোমাদের অভিভাবক হিসেবে আমার আরো একটি কামনা আছে- মানুষের মতো মানুষ করে তোমাদেরকে গড়ে তোলা। সততায় তোমরা যেনো অন্যদের কাছে অনুকরণীয় হতে পারো, আদর্শ হতে পারো, চেষ্টা করবে নিজেকে তেমন ভাবে গড়ে তুলতে।
শ্রেয়া আপু সমাজবিজ্ঞান পড়ান। আমাদের মেয়ের মতো স্নেহ করেন আর প্রশ্ন করে করে সবার সুবিধা-অসুবিধার কথা জেনে নেন। তারপর যাদের সমস্যা রয়েছে তাদেরকে তিনি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ বলে দেন। সম্ভব হলে নানাভাবে সাহায্য করেন।
আমাদের ক্লাসের সব মেয়ে তো শান্তশিষ্ট ছিল না-দু’চারটি দুষ্টু মেয়েও ছিল। যখন-তখন খিলখিল করে হেসে উঠতো ওরা। খুকখুক করে কাশি দিয়ে পড়ার গতি কমিয়ে দিতো। অংক খাতায় হাতি-ঘোড়া এঁকে রাখতো। এমন যদি অংক স্যারের পিরিয়ডে করা হতো, স্যার তখন পড়া বন্ধ রেখে আমাদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেন। এক এক করে সবার ওপরে দৃষ্টি ছুঁইয়ে অপরাধীকে খুঁজে বের করতেন। অপরাধীকে শনাক্ত করতে না পারলে তার অংক শেখানোয় মন বসতো না। আর যদি অপরাধী শনাক্ত হতো তখন তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বলতেন, কান ধরে দাঁড়া। আর কোনোদিন এমন করলে পিটিয়ে হাড় গুঁড়ো করে দেবো!…
সেই মেয়েগুলো যতোই দুষ্টু হোক, স্যারদের আদেশ অমান্য করবে অমন দুষ্টু তো ছিল না। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে ওরা কান ধরে দাঁড়াতো আর তা দেখে আমরা কিটমিট করে হাসতাম।
শ্রেয়া আপু কিন্তু কোনো দুষ্ট মেয়েকে সাজা দিতেন না। কেউ যদি খুকখুক শব্দ করতো, তাহলে তিনি তার পার্টস খুলে ম্যানথল মিক্সড লজেন্স বের করে বলতেন, নাও, এটা খেয়ে নাও। খেলে খুসখুসে কাশি সেরে যাবে। আর না সারলে সমস্যা নেই, নিশিকান্ত স্যারের তো হোমিওপ্যাথি জানাই আছে। তার কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে দেবো। তোমার কাশি সেরে যাবে।
আমাদের ক্লাস শুরু হতো সকাল দশটায় আর শেষ হতো বিকেল চারটায়। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে আমরা লাইন ধরে দাঁড়াতাম। স্যার আর আপুমণিরাও মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াতেন। একেক দিন একেক ক্লাস থেকে চারজনকে বেছে নেয়া হতো। ওরা সুর করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতো আর আমরা সেই সুরে সুর মেলাতাম। তারপর শুরু হতো সেদিনের ক্লাস। কলেজেও কি এমন করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে? নাকি হুট করে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে? এমন হাজারটা প্রশ্ন সারাটা ক্ষণ আমাকে চিন্তিত করে রাখে।
কতো কথা মনে পড়ে স্কুল ছেড়ে যেতে হবে মনে পড়লে!
একদিন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়েছি। এমন সময় পিটি স্যার এসে বললেন, অধরা! তোর ইউনিফর্মে দাগ লেগেছে কেমন করে? জানিস না, নোংরা ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আসা নিষেধ?
আমি বললাম, জানি স্যার।
স্যার বললেন, জানিস তো দাগ লাগানো ইউনিফর্ম পরে এসেছিস কেন? যা, আজ তোর ক্লাস করা চলবে না। বেরিয়ে যা লাইন থেকে।
সেখানে সেদিন শ্রেয়া আপুও ছিলেন। পিটি স্যারের কথা শেষ হতেই তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ইউনিফর্মে ময়লা লেগেছে বলে ক্লাস করতে দেবো না, আমরা এতোটা কঠোর নাইবা হলাম। অধরাকে ক্লাস করতে দেবো। তবে ময়লা লাগিয়েছে কেমন করে, সে কথাটাও জেনে নেবো। তো অধরা, ইউনিফর্মে ময়লা লাগিয়েছো কেমন করে, সে কথা বলো।
আমি বললাম, স্কুলে আসার সময় এক অন্ধ ভিখেরি পথ পার করে দেয়ার জন্য সবাইকে রিকোয়েস্ট করছিলেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছিল না। সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছে। আমি তখন তাকে পথ পার করে দিয়েছি। আমি সামনে ছিলাম আর তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে পথ পার হয়েছেন। তার হাত থেকে কাঁধে ময়লা লেগেছে। বাসায় গিয়ে যে ইউনিফর্মটা বদলে আসবো, তেমন সময় ছিল না আপু। নইলে আমি ময়লা ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আসতাম না।
আমার কথা শুনে শ্রেয়া আপু বললেন, বুঝেছি ময়লা লাগার কারণ। এক অন্ধ বুড়োকে পথ পার করে গিয়ে ইউনিফর্মে ময়লা লেগেছে। তা লাগুক। এমন ভালো কাজ করতে গিয়ে ইউনিফর্ম ময়লা হলেও কিছু এসে যায় না।
পিটি স্যারও সেদিন শ্রেয়া আপুর কথায় সায় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, অমন একটা ভালো কাজ করার কারণে ময়লা লেগেছে তা যদি আগে জানাতিস, তবে আর তোকে বকুনি খেতে হতো না। তোর জন্য গর্ব হচ্ছে অধরা। এমন করে সব সময় বিপদগ্রস্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবি।
শ্রেয়া আপু আর পিটি স্যার যেদিন আমার প্রশংসা করেছিলেন, তারপর কেটে গেছে অনেক দিন। অথচ এখনও আমার মনের কোণে সেই স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। যখন কলেজে পড়বো, আমার নতুন নতুন বন্ধু হবে, দিন কাটবে নতুন পরিবেশে- তখন কি আমি এসব স্মৃতি ভুলে যাবো? কলেজের স্যার-ম্যাডামরাও কি আমাকে ভালো কাজে এভাবে উৎসাহ দেবেন? কে আমাকে এসব প্রশ্নের জবাব দেবে?
আমি শুধু সারাটা ক্ষণ আল্লাহকে ডেকে বলবো, হে আল্লাহ! আমি আমার স্কুল জীবনের সুন্দর স্মৃতিকে ভুলে যেতে চাই না। কিছুতেই না…

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য