মুখ পুড়লো শেয়ালের- আমিনুল ইসলাম হুসাইনি

মুখ পুড়লো শেয়ালের- আমিনুল ইসলাম হুসাইনি

মুখ পুড়লো শেয়ালের

আমিনুল ইসলাম হুসাইনি
গ্রাম থেকে অনেক দূরে, হিজলতলী বন। সেই বনে বাঘ ছিল। হরিণ ছিল। শেয়াল ছিল। গাছের ডালে বানর ছিল। লাল-নীল পাখিও ছিল। হাতি ঘোড়া সব থাকলেও বনে কোনো রাজা ছিল না। সাত দিন আগে কি একটা অসুখে বনের রাজা সিংহ মারা যান। রাজার শোকে পশুপাখিরা যখন কাঁদছিল, তখন পাজি শেয়ালটা আড়ালে বসে হাসছিল। আর মনে মনে ভাবছিল- আমি হবো বনের রাজা/ সবক’টাকে দেবো সাজা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পাজি শেয়াল আজ বনবেড়ালের মাছ কেড়ে নেয়, তো কাল পাখিদের ডিম খেয়ে নেয়। ভয়ে বনের পশুপাখির ঘুম উধাও।

বোকা কুমিরের সাত সাতটা ছানা খাওয়ার পর পাজি শেয়ালের চোখ পড়ে বকের বাসায়। বকেরা ছিল তিন ভাই। বড়ো আর ছোটবক উড়তে পারলেও মেঝবকটা উড়তে পারে না। ঝড়ে তার ডানায় আঘাত পেয়েছে কি না, তাই!
তিন ভাই একই বাসায় থাকে। বড়োভাই বনে গিয়ে কাঠ কাটে। ছোটভাই শিকার করে টাটকা পুঁটি মাছ। আর মেঝভাই সেই পুঁটি মাছ এত মজা করে ভাজে যে, জিভ থেকে টুপ করে জল খসে পড়ে।

বকদের ঘর ছোট হলেও সুখের কোনো অভাব ছিল না। তবে পাজি শেয়ালের চোখ পড়ায় ওদের এখন খুবই ভয় হয়। বিশেষ করে মেঝবকটাকে নিয়ে। বড়ো আর ছোটবক তো সেই সকালে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বাসায় ফেরে দুপুরের অনে…ক পর। এ সময় মেঝবক একাই থাকে। পাজি শেয়াল যদি এ সময়ে কিছু একটা করে বসে? মেঝবকটা যদি উড়তে পারতো, তাহলে এত ভাবতে হতো না।

চারদিন হলো বড়োবক কাঠ কাটতে যায় না। ছোটবকও মাছ শিকারে যায় না। ঘরেই বসে বসে মেঝবককে পাহারা দেয়। চারদিন পর দেখা গেল- বাসায় যে কাঠ আর মাছ জমা ছিল, সবই শেষ। লোকে কি আর সাধে বলে- বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়।

আজ সকালে বড়োবক আর ছোটবক ঘর থেকে বেরিয়েছে। বের হওয়ার আগে মেঝকে সাবধান করে বলে গেছে- আমরা কাজে যাবো। তুমি ঘরদোর দেখে রেখো। তবে সাবধান! ভুলেও ঘরের দরজা খুলবে না। পাজি শেয়াল যা-ই বলুক, ঘর থেকে একদমই বের হবে না।

পাজি শেয়ালটা পাশের ঝোপেই লুকিয়ে ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে সে বকদের সব কথা শোনে আর ঠোঁট টিপে হাসে।
বড়োবক আর মেঝবক যেই ঘর থেকে বের হয়েছে, অমনি পাজি শেয়ালও ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে। বকের বাসার সামনে এসে ছড়া কাটে-
মেঝবক, মেঝবক
লাগবে নাকি পুঁটি?
লাগলে পুঁটি দরজা খুলে
বাড়াও তো ঠোঁট দুটি।

পুঁটি মাছের টোপ দেখে মেঝবক সব ভুলে যায়। ভাইদের বারণ না শুনে দরজা খুলে বসে। কাচির মতো দুই ঠোঁট বের করে যেই বেরিয়ে আসে, অমনি পাজি শেয়াল খ্যাঁক করে তার মাথায় কামড়ে ধরে। তারপর বনের দিকে ছুটতে থাকে।
মেঝবক বুঝতে পারে বাঁচতে হলে তাকে এখনই ছড়া ধরতে হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। মেঝবক ছড়া কেটে চলে-
পাজি শেয়াল নিল ধরে
জলদি এসো ভাই,
তোমরা ছাড়া এই বনে যে
সাহস কারো নাই।
মেঝবকের গলা শুনে বড়ো আর ছোটবক একটুও দেরি করে না। বাতাসের মতো শো শো করে উড়ে আসে। এসেই শেয়ালের কানে, চোখের পাতায় ঠোকর বসিয়ে দেয়। বকেদের ইয়া বড়ো বড়ো ঠোঁট। সেই ঠোঁটের আঘাতে শেয়ালের কান, উঁচু নাক আর থুতনি কেটে রক্ত বের হয়। মেঝবককে রেখে শেয়াল এবার জীবন বাঁচাতে দৌড়ে পালায়।

মেঝবককে নিয়ে বড়ো আর ছোটবক বাসায় ফিরে। মেঝবকের অমন বোকামির কারণে ওরা একটু বকাঝকা করে। তাতে মেঝবকের ঠোঁট অভিমানে ফুলে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, উড়তে পারি না বলে পাজি শেয়াল সুযোগ নিল। আমি নাহয় একটু বোকা। শেয়ালের মতো লোভী তো নই। তোমরা আমাকে এভাবে বকতে পারলে? এই আমি চললাম। আমাকে নিয়ে তোমাদের আর ভাবতে হবে না।
এই বলে মেঝবক কাপড়চোপড় গোছাতে শুরু করে। বড়োবক তখন ছোটবককে মিছেমিছি বকা দেয়। এতে কাজ হয়। মেঝবকের অভিমান কমে। এরপর তিন ভাই মিলে শেয়ালকে বন ছাড়া করার উপায় ভাবতে থাকে।

পরদিন সকালে পাজি শেয়ালটা আবারো আসে। ঝোপের ভেতর লুকিয়ে থেকে বকেদের কথা শোনে। ঘরের ভেতর বড়োবকের গলা শোনা যায়। মেঝবককে ধমকে বলছে, শোন বোকাবক, ঘরের কোণে যে কলসটা লুকানো আছে, ওটায় আমি সাতটা ডিম লুকিয়ে রেখিছি। ঘর থেকে কোথাও যাবি না। তাহলে পাজি শেয়াল ডিমগুলো খেয়ে নেবে।

ঝোপের ভেতর থেকে বড়বকের এই কথা শুনে শেয়ালের জিভে পানি চলে আসে। মনে মনে ভাবে, আহা! কতদিন হয় ডিম খাওয়া হয় না। যেভাবেই হোক মেঝবককে ঘর থেকে বের করতে হবে।
বড়োবক আর ছোটবক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, শেয়ালও ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। বকের ঘরের সামনে এসে ছড়া কাটে-
গহীন বনে দেখে এলাম
হাঁটু-পানির বিল
ভাঁদা পুঁটি, তেলা পুঁটি
করছে যে কিলবিল।

পুঁটির নাম শুনে মেঝবক আবারও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দেখে, পাজি শেয়ালটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার পিলে চমকে ওঠে। শেয়াল বলে, ভয় পেয়ো না ভাই। কালকের ঘটনাটির জন্য আমি ক্ষমা চাই। তোমাকে সে কথাটিই বলতে এলাম।
পাজি শেয়ালের মনভোলানো কথায় মেঝবক আবারও বোকা হয়ে যায়। বড়োবক যে তাকে ঘরে থাকতে বলেছে, সে কথাও ভুলে যায়। শেয়ালের কাছে জানতে চায়, তখন কি যেন বলছিলে?
পাজি শেয়াল আবারো ছড়া কাটে-
গহীন বনে দেখে এলাম
হাঁটু-পানির বিল
ভাদা পুঁটি, তেলা পুঁটি
করছে যে কিলবিল।

শেয়ালের ছড়া শেষ হতেই মেঝবক উধাও। গহীন বনে হাঁটু-পানির বিলে চলে গেছে হয়তো। তার এই বোকামি দেখে পাজি শেয়াল হো হো করে হাসে। মনে মনে বলে, বোকা কোথাকার। মাথায় এক চিমটি ঘিলুও নেই।
দরজা খোলা। আর দেরি কেন? শেয়াল তখনই ঘরের ভেতর ঢোকে। ঘরে ঢুকতেই চোখ চকচকিয়ে ওঠে। বোকাটা কলসের মুখটাও ঢেকেও যায়নি। ডিমগুলো যেন শেয়ালের চোখের তারায় ভেসে ওঠে।
শেয়াল আর একটুও দেরি না করে কলসের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে দেয়। মুখ ঢোকাতেই পাজি শেয়াল চেঁচিয়ে ওঠে- মুখ পুড়ে গেল রে, মুখ পুড়ে গেল!
ঘরের বাইরে তখন বড়োবক, মেঝবক, ছোটবকসহ বনের যত পশুপাখি ছিল- সবাই একসাথে হেসে ওঠে। হাসবেই না কেন? পাজি শেয়ালটা তাদের কম জ্বালিয়েছে?
শেয়াল এবার বুঝতে পারে, তার মুখ পোড়াতেই কলসিতে গরম পানি রাখা হয়েছিল। আর কলসের ভেতর তার মুখটা এমনভাবেই আটকে গিয়েছিল যে, পাজি শেয়াল কোনোভাবেই মুখ বের করতে পারছিল না। কথায় আছে না, লোভে পাপ পাপে মরণ। পাজি শেয়ালের সেই দশাই হলো।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য