ঈদের খুশি ছড়ায় ছড়ায় – আইমান খালিদ

ঈদের খুশি ছড়ায় ছড়ায় – আইমান খালিদ

ঈদের খুশি ছড়ায় ছড়ায়
আইমান খালিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।
-কাজী নজরুল ইসলাম।
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। ঈদ আসে সীমাহীন প্রেম প্রীতি ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে। ঈদ আহবান করে একতার, সাম্যের, প্রীতির। ঈদ শিক্ষা দেয় সকল মলিনতা আর কলুষতাকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে, হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে, পরস্পর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে।
মহান আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মার জন্য ঈদকে উৎসব হিসেবে দান করেছেন। ‘রাসূল সা. যখন মদিনায় আগমন করলেন, মদিনাবাসীর বিশেষ দু’টি দিন ছিল। এ দু’টি দিনে তারা খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তি করতো। নবীজী সা. জানতে চাইলেন এ দু’টি দিনের তাৎপর্য কি?
মদিনাবাসী উত্তরে জানালো, আমরা জাহেলি যুগে এ দু’দিন খেলাধুলা করতাম। নবীজী বললেন, আল্লাহ দু’টি দিনের পরিবর্তে শ্রেষ্ঠ দু’টি দিন তোমাদের দিয়েছেন। একটি হলো ঈদুল ফিতর ও আর অন্যটি ঈদুল আযহা।’

[সুনানে আবু দাউদ: ১১৩৪]
ঈদ এলে ছোটবড় সবাই খুশিতে নেচে ওঠে। মনে আনন্দের দোলা লাগে। ঈদের খুশি ছড়িয়ে দিতে কবিরা লিখেছেন ছড়া-গান। রচিত হয়েছে অসংখ্য-গদ্য-পদ্য। এই যেমন ঈদ আসলেই কণ্ঠে কণ্ঠে বেজে ওঠে কবি নজরুলের গান-
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশীর ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে
শোন আসমানি তাকিদ।’

যে গানটি ছাড়া অপূর্ণই যেনো রয়ে যায় ঈদানন্দ। জানা যায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় শুরু হয় ঈদ নিয়ে লেখালেখি। সেই থেকে আজ-রচিত হয়েছে বহু ছড়া কবিতা গান।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি কায়কোবাদের কবিতাটা তো কোনোভাবে ভুলতেই পারি না। কি অসাধারণ উচ্চারণ-
‘আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব এক মনপ্রাণ
জাগায়ে মুসলিম যাবে গাহি আজি মিলেনের গান
ডুবিবে না তবে আর ঈদের এ জ্যোতিষ্মান রবি
জীবন সার্থক হবে, হইবে যে এ দরিদ্র কবি।
আনন্দের উৎসব, ঈদকে নিয়ে কবি কায়কোবাদ অন্য একটি কবিতায় লিখেছেন-

“এই ঈদ বিধাতার কি যে শুভ উদ্দেশ্য মহান, হয় সিদ্ধ,
বুঝে না তা স্বার্থপর মানব সন্তান।
এ তো নহে শুধু ভবে আনন্দ উৎসব ধুলা খেলা।
এ শুধু জাতীয় পুণ্যমিলনের এক মহামেলা।”

মুসলিম রেনেসাঁর কবি, ছোটদের কবি, বড়দের কবি ফররুখ আহমদও লিখেছেন ঈদ নিয়ে। তিনি পুরো দুনিয়াটাকে ঈদগাহের সাথে তুলনা করে ‘ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই’ কবিতায় লিখেছেন-

আজকে এল খুশীর দিন
দেখ না চেয়ে খুশীর চিন
দেখ না চেয়ে আজ রঙিন
খুশীর ঝলক ঈদগাহে।

জামাত ছেড়ে থাকবে যে ঘরের কোণে
রইবে সে রইবে হয়ে একপেশে
একলা থাকায় দুঃখ তাই।
সবাই মিলে একদলে
এক আশাতে যাই চলে
এক আশাতে যাই বলে
ঈদগাহ হবে দুনিয়াটাই।
খুশির দিনে সবাই মিলে একসাথে ঈদগাহে যাওয়ার যে আনন্দ সেটাই উপভোগ করার আহব্বান কবির কবিতায়। এই ঈদের দিনে এক আশাতে সুখ দুঃখ ভুলে ধনী গরিব ছোটে ঈদগাহের দিকে। তাই কবি পুরো দুনিয়াটাকেই ঈদগাহ বলেছেন। মুসলিমদের মহামিলন মেলা।

ঈদ আসলেই ব্যক্তি হতে পরিবার সমাজ- সবার মাঝে সৃষ্টি হয় নব উদ্দীপনা। নতুন জাগরণ। সমাজে ঈদনান্দ খুশির প্রভাব সম্পর্কে কবি আ.ন.ম বজলুর রশিদ তার ‘ঈদ আসে’ কবিতায় লিখেছেন-

ঈদ আসে হাসি-খুশী
তোমাদের আমাদের সকলের ঘরে অনেক আনন্দ নিয়ে
কিছুক্ষণ ভুলে যাই দুঃখ জ্বালা যত
আজ শুধু মেলামেশা অন্তরঙ্গ হয়ে থাকা
অবিরত আল্লাহর প্রশংসায় গান,
তাঁর দয়া দাক্ষিণ্যের অমৃত ঝরে।

ঈদের নতুন চাঁদ সকলের তরে আনন্দময় হয় না বা সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনে না। গরিব-দুঃখিদের দুঃখ-কষ্ট দূর হয় না। তাদের মনের আকুলতা ফুটে উঠেছে কবি তালিম হুসেনের ‘ঈদের ফরিয়াদ’ কবিতায়-
ঈদ মোবারক, সালাম বন্ধু, আজি এই খুশরোজে
দাওয়াত কবুল করো মানুষের বেদনার মহাভোজে
কহিবো কি আর, চির-মানুষের ওগো বেদনার সাথী
ঈদের এদিন শেষ হয়ে আসে, সমুখে ঘনায় রাতি।’
একটু হাসি আনন্দে তারা ও নেচে উঠবে অনাবিল সুখে। সমাজে নেমে আসবে শান্তি-সুখের ফল্গুধারা। এ দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করেই সম্ভবত কবি গোলাম মোস্তফা ঈদকে মানবতার বিরাট অংশ বিবেচনা করেন। প্রীতি সমপ্রীতি মিলনমেলার আনন্দ মেখে ঈদ উৎসব কবিতায় তিনি লিখেছেন।

“কণ্ঠে মিলনের ধ্বনিছে প্রেম-বাণী,
বক্ষে ভরা তার শান্তি,
চক্ষে করুণার স্নিগ্ধ জ্যোতি ভার,
বিশ্ব-বিমোহন কান্তি প্রীতি ও মিলনের
মধুর দৃশ্যে এসেছে নামিয়া যে নিখিল বিশ্বে
দরশে সবাকার মুছেছে হাহাকার বিয়োগ-বেদনার শ্রান্তি।”

ঈদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা ও গান লিখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার কণ্ঠে বেজে উঠেছিল সাম্যের গান। তাই ঈদের দিনে ছোট-বড়, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে গেয়ে উঠিÑ
আজি ইসলামি ডঙ্কা গরজে ভরি জাহান,
নাই বড় ছোট সকল মানুষ এক সমান,
রাজা প্রজা নয় কারো কেহ।
কে আমীর তুমি নওয়াব বাদশা বালাখানায়?
সকল কালের কলঙ্ক তুমি জাগালে হায়
ইসলামে তুমি সন্দেহ।
ইসলাম বলে সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ দুখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই
নাই অধিকার সঞ্চয়ের।

ইসলামে গরিব-দুখি, অসহায় ক্ষুধার্তের প্রতি সমব্যথী হয়ে যে যাকাত ছদকার বিধান প্রণয়ন করেছে তা পালনার্থে ইসলাম শিখিয়েছে ভ্রাতৃত্ববোধ। যাকাত ফেতরা দানের প্রতি কবি তার ঈদ মোবারক কবিতায় আহ্বান করে কী সুন্দর লিখেছেন-

ঈদ উল ফিতর আনিয়াছে তাই নববিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,
ক্ষুদার অন্ন হোক তোমার!
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও-পেয়ালাতে,
দিয়া ভোগ কর, বীর দেদার।
বুক খালি করে আপনারে আজ দাও জাকাত,
করো না হিসাবী, আজি হিসাবের অঙ্কপাত!
একদিন করো ভুল হিসাব।
আহ্, ঈদের দিনের সে কী আনন্দ। হৈ হুল্লোর। নতুন জামা নতুন জুতায় হেসে ওঠে বাঁকা চাঁদ। ছোটদের তো কথাই নাই, কচকচে টাকা আর বড়দের স্নেহে আনন্দ আর ধরে না। ঈদগাহে যেতে সে তো অন্যরকম আনন্দ। পথে পথে সালাম প্রিয়জনদের কোলাকুলি। কবি নজরুল সে আনন্দকেই তুলে ধরেছেন ঈদ মোবারক কবিতায়-
পথে পথে আজ হাঁকিব, বন্ধু,
ঈদ মোবারক! আসসালাম!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী
ফুল-কালাম!
শাওয়ালের আকাশে ঘটা করে আগমন ঘটে রুপোলী চাঁদের। পশ্চিমাকাশে ঝিলিক তুলে মুচকি হেসে জানিয়ে দেয় ঈদ এসেছে, সবার মাঝে/সাজো রঙিন সাজে। এক ঈদ চলে গেলে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে থাকে মানুষ। আবার কবে ফিরে আসবে সুখ স্মৃতি আনন্দের এই ঈদ। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এ দিন নিয়ে কবি বেগম সুফিয়া কামাল তাঁর ‘ঈদের চাঁদ’ কবিতায় লিখেছেন-

“চাঁদ উঠিয়াছে,
ঈদের চাঁদ কি উঠেছে?
শুধায় সবে।
লাখো জনতার আঁখি থির আজি
সুদূর সুনীল নভে।
এই ওঠে, ওই উদিল গগনে সুন্দর
শিশু চাঁদর আমিন। আমিন।
রাব্বুল আলামিন করে সবে মোনাজাত।”
সৈয়দ আলী আহসান ঈদের চিকন চাঁদের ফুটফুটে হাসিতে আগামী দিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছেন। ঈদের দিনে আমরা যা করি, মেশেকের রেণু খোশবু আতরের ঘ্রাণে মাতোয়ারা করি চারদিক। নতুন জামা পরে আনন্দে উদ্ভাসিত হই। কবি তার ভাষায় এভাবেই চিত্রিত করেছেন-
“এসেছে নূতন দিন আলো শতদল পাপড়ি মেলেছে,
কুয়াশা হয়েছে ক্ষীণ।
জরির জোব্বা,
শেরোয়ানী আর আমামার সজ্জায় আতরের পানি,
মেশেকর রেণু খোশবু বিলায়ে যায়
বাতাসে বাতাসে কলরোল আজি,
ভেঙেছে তন্দ্রা ঘোর সাহেবজাদীর নেকাব টুটেছে,

রাত্রি হয়েছে ভোর।” (এসেছে নূতন দিন)
কবি সিকান্দার আবু জাফর ঈদ উপলক্ষে দোয়া চেয়ে পিতার কাছে লেখা ‘ঈদের চিঠি’তে গরিবদের চিরাচরিত ঈদের চিত্র কি সুন্দর করে ফুটে ওঠে। তিনি লিখেছেন-

“ঈদের সালাম নিও,
দোয়া করো আগামী বছর কাটিয়ে উঠতে পারি যেনো
এই তিক্ত বছরের সমস্ত ব্যর্থতা।
অন্ততঃ ঈদের দিন সাদাসিধে লুঙ্গি একখানি,
একটি পাঞ্জাবী আর সাদা গোলটুপি তোমাকে পাঠাতে যেনো পারি;
আর দিতে পারি পাঁচটি নগদ টাকা।”

ঈদ শুধু সুথ আনন্দের নামই নয়। ঈদ আমাদের কে শিক্ষা দেয় ভাতৃত্বের। সহমর্মিতার। অপরের প্রতি দায়িত্ববোদের। ঈদের মহান শিক্ষাই হচ্ছে ভেদাভেদ-হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়া। এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে ঈদের জামায়াতে দাঁড়িয়ে ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ঈদ সচরাচর দেখা যায় না। আজ ঈদের দিনও দেখা যায় গ্রামের হতদরিদ্র কৃষকরা শীর্ণ গরুর পাল নিয়ে মাঠে যায় জমিতে লাঙল দিতে। কবি নজরুল তাদের কথাই বলেছেন তার “কৃষকের ঈদ” কবিতায়। কবি লিখেছেন-

“জীবনে যাদের হররোজ রোজা
ক্ষুধায় আসে না নিদ,
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে
এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে
যে খোকা মরিল তার উঠেছে
ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পুঁজরের হাড়?”

কবি তফাজ্জল হোসেন খান চমৎকার একটি গান লিখেছেন ঈদ নিয়ে। প্রতি বছর ঈদ এলেই সুর করে শিশুরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে।
“আজ আনন্দ প্রতি প্রাণে প্রাণে
দুলছে খুশীর নদী প্লাবনে ঘরে ঘরে
জনে জনে
আজি মুখর হব মোরা গানে গানে
ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক আজ
বল ঈদ মোবারক আজ।”

আনন্দের দিন; ধনী গরিব শ্যামবর্ণ গৌরবর্ণ নির্বিশেষে সবাই নেচে উঠবে ঈদের খুশিতে। সবার হৃদয়ে বুলিয়ে দেবে প্রেম প্রীতি ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দ আর শান্তির পরশ। ঈদ থেকে শিক্ষা নিয়ে সারাবছর নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে পারলেই সার্থক হবে ঈদ উৎসব। ঈদের দিন যেভাবে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে এককাতারে দাঁড়িয়ে যায়, সারাবছর ধরে সেই বিভেদের দেয়ালকে ছাপিয়ে গড়ে তুলতে হবে ঐক্যের পাহাড়। তাহলেই ঈদের দিনে সুখানন্দে জেগে উঠবে মন। নেচে উঠবে অন্তর। থাকবে না ভেদাভেদ। প্রাণে প্রাণে বেজে উঠবে সুখের বীন। সবাই মিলে গেয়ে উঠবো কবি গোলাম মোস্তফার কণ্ঠে।

“আজি সকল ধরা মাঝে বিরাট
মানবতা মূর্তি লভিয়াছে হর্ষে,
আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়েছে
রাখিতে হবে সারা বর্ষে,
এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য
নিখিল-মানবের মিলন জন্য,
শুভ যা জেগে থাক,
অশুভ দূরে যাক
খোদার শুভাশীষ স্পর্শে।”
এছাড়াও অনেক অনেক বিখ্যাত ছড়া-কবিতা, গান রচিত হয়েছে ঈদ নিয়ে।
ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়ুক দেশে দেশে, গ্রামে-গঞ্জে, সবার প্রাণে সবার ঘরে। ঈদ মোবারক আসসালাম।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য