ছন্দ-ছড়া আর ছোটদের কবি নজরুল- জিয়াউল আশরাফ

ছন্দ-ছড়া আর ছোটদের কবি নজরুল- জিয়াউল আশরাফ

আমাদের বাংলাদেশ। সুন্দর রূপময়। সুবুজ শ্যামল-ফল-ফুলের দেশ। ধানের দেশ, গানের দেশ। হাজারো কবির কবিতার দেশ। ছন্দ-ছড়ার দেশ। এদেশের রূপ যেমন কবিকে পাগল করেছে, তেমনি ছোটদের চঞ্চলতাও পাগল করেছে কবিকে। ছোটরা প্রজাপতির মতো। পাখির মতো। এই ছোটদের নিয়ে লিখেছেন কবি-সাহিত্যিকগণ।
তেমনি একজন আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, ছোটদের কবি, কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কাজী নজরুলের জীবন ছিলো কষ্টের। জন্মের পর থেকেই নানান দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। কাজ করেছেন। রুটিন দোকান থেকে মসজিদের মুয়াজ্জিন। গানের দল থেকে সেনাবাহিনী। তবে তিনি পড়েছেন এবং লিখেছেন। কবির অধম্য চেষ্টা, দূরন্ত মন কবিকে বিখ্যাত করেছে। হয়েছেন সবার প্রিয়। শক্তিমান লেখায় কবি হয়েছেন-বরণীয় এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি লিখেছেন বড়দের জন্য-গল্প উপন্যাস গান কবিতা। ছোটদের জন্য লিখেছেন দু’হাত ভরে। কবির হাতের ছোঁয়ায় শিশুসাহিত্যের শাখা পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ছোটদের জন্য তিনি রচনা করেছেন অনেক কাব্য ও ছড়াগন্থ। সবগুলো তো সম্ভব নয়। তবে কিছু বইএর নাম বলে দিচ্ছি। তন্মধ্যে ঝিঙে ফুল, পুতুলের বিয়ে, ঝড় এবং পিলে পটকা, পুতুলের বিয়ে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছোট বড় সবার প্রিয় কবি। সবার জন্যই লিখেছেন।
তার লেখায় ছোটদের মেধার বিকাশ ঘটে। হাসি আনন্দের উপলক্ষ্য তৈরি হয়। কবির লেখায় বাংলা সাহিত্য ও বাংলাভাষা সম্মৃদ্ধ হয়েছে।
কবি কাজ করেছেন শিশুদের নিয়ে। শিশুদের ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছা জাগিয়ে তুলেছেন কবি নজরুল। তাদের মনের কথা, মান অভিমানের কথাগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুণভাবে।
সকালের পরিবেশ জান্নাতি পরিবেশ। ঠাণ্ডা-শীতল হাওয়া মন ছুয়ে যায়। সকালে পাখিরা জেগে উঠে। জেগে উঠে মুমিন। ফজরের আযানের ধ্বনি পৃথিবীর শ্রেষ্ট সুর। কবি চেয়েছেন-শিশুরা জেগে উঠুক পাখির সাথে, মুয়াজ্জিনের সুরের সাথে। মিনারের আহবানে জেগে উঠুক পৃথিবী। সেই সকাল বেলা উঠা নিয়ে কবি লিখেছেন প্রভাতী নামক কবিতা। এই কবিতার মধ্য দিয়ে শিশুদের কথা বা শিশুদের অভিভাবকদের কথা ফোটে উঠে। তিনি এইভাবেই বলেছেন:

‘ভোর হোলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে জুঁই-শাখে ফুল-খুকী ছোট রে!
খুলি হাল তুলি পাল ঐ তরী চলল
এই বার এই বার খুকু চোখ খুলল।’

খোকা সকাল বেলার পাখি হতে চায়, কিন্তু সেখানে বাদ সাধে তার মা। তার মা সকালে খোকাকে উঠতে দিতে চায় না, মা বলে এখনো সকাল হয়নি ঘুমিয়ে থাকো। আরও পরে ঘুম থেকে উঠো। তাই খোকা মাকে আলসে মেয়ে বলেছে। খোকা তার মাকে এও বোঝানোর চেষ্টা করেছে আমরা জাগলেই তবে সকাল হবে। তাই কবি লিখেছেন:

‘আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।
সূয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’ মা বলবেন রেগে।
বলব আমি,’আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল- তাই বলে কি সকাল হবে না ক?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’
কিশোর মন দূরন্ত। ছুটে চলা নদীন মতো। নানান চিন্তা, নতুন নতুন স্বপ্ন মাথায় খেলা করে। কিশোর মনে নানান ভাবের উদ্রেক হয়। শিশুদের অদম্য ইচ্ছাকে সুন্দররূপে ফুটিয়ে তুলেছেন সংকল্প কবিতায়। তিনি লিখেছেন:

‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে ছুটছে তারা কেমন করে,
কীসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কীসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।’

ছোটবেলায় এসব কবিতা পড়েনি এমন মানুষ আমাদের দেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তোমরাও নিশ্চয় পড়েছ এসব কবিতা।
এবারে শোনো তার একটি কবিতা লেখার মজার কাহিনি। একদিন নজরুল বসে আছেন বারান্দায়। হঠাৎ তার চোখ পড়ল ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ের দিকে। নাম তার অঞ্জলি। নজরুল দেখলেন, একটা পেয়ারাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে চোখ-ঠোঁট উল্টিয়ে, হাত-পা নেড়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে অঞ্জলি। নজরুল ভাবলেন, নিশ্চয় কেউ পেয়ারাগাছে উঠেছে। তিনি ভাবলেন, গাছে যে আছে তার কাছে অঞ্জলির জন্য একটা পেয়ারা চাইবেন। কিন্তু কাছে গিয়ে গাছে কাউকেই দেখতে পেলেন না। তাহলে কার সঙ্গে কথা বলছিল অঞ্জলি?
অঞ্জলিকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে?
অঞ্জলি বলল, কাকাবাবু! ওই দেখো দুষ্টু কাঠবেড়ালি। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না।
কাঠবেড়ালির সঙ্গে অঞ্জলির এই
মান-অভিমানের ঘটনাটি নজরুলের মনে এতটাই দাগ কাটল যে, তিনি লিখে ফেললেন ‘খুকী ও কাঠবিড়ালি’ নামের কবিতাটিÑ

‘কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!

ছোটদের পাঠ্যবইয়ের জন্য একদিন তিনি যে কবিতা লিখেছিলেন, সেটা তো এখনও সব ছোটদেরই মুখে মুখে। শুধু কি ছোটদের মুখে মুখে! এমন কবিতা কি বড় হয়েও কেউ ভুলে যায়! কবিতাটি হলোÑ
বাবুদের তাল পুকুরে
হাবুদের ডাল কুকুরে
সেকি ব্যস করলো তাড়া
বলি থাম একটু দাঁড়া

ছোটবেলায় সব শিশুই যেমন চায় বাবার মতো হতে, তেমনি নজরুলও নিশ্চয় চাইতেন। নইলে তিনি এমন কবিতা লিখবেন কেন?Ñ
আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা,
না হলে তার নামতা,
মারতাম মাথায় টোকা।
রোজ যদি হত রবিবার!
কি মজাটাই হত যে আমার!
কেবল ছুটি! থাকত না কো নামতা লেখা জোকা!
থাকত না কো যুক্ত অক্ষর, অঙ্কে ধরত পোকা।

ঝিঙেফুল দেখেছ তোমরা? ওই যে মাচার ওপর সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে থাকে হলুল হলুদ ফুল। সেই ঝিঙেফুলকে নিয়ে কবিতা লেখার কথা কেউ ভাবতে পারে! কিন্তু নজরুল লিখেছেনÑ
ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল
সবুজপাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল
ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল

বাবা-মা পড়তে বলছে, কিন্তু তোমার ইচ্ছে করছে শুয়ে থাকতে, অথবা মায়ের আচারের বয়াম থেকে একটু আচার খেতে, এমন হয় না তোমাদের? নজরুলেরও হতো নিশ্চয়। তাইতো তিনি লিখেছেনÑ
একেককে এক
বাবা কোথায় দেখ।
দুয়েককে দুই
নেইক? একটু শুই।
তিনেককে তিন
উহু হু! গেছি! আলপিন!
চারেককে চার
ঐ ঘরে আচার

তোমাদের কবি! প্রিয় কবি, কাজী নজরুল ইসলাম। তোমাদের জন্য লিখেছেন অসংখ্য ছড়া-গল্প। যা তোমরা বড় হলে পড়বে। বিভিন্ন বইয়ে পড়বে। তিনি কেন লিখতে পারতেন জান? তিনি ছোটদের খুব ভালোবাসতেন। ছোট সাথে মজা করতেন।
কোন এক কবিতায় তিনি নিজেই বলেছেন, আমি চির শিশু, চির কিশোর। কেন বলেছেন? কারণ বড় হয়েও তার ছিল শিশুদের মতোই সহজ-সরল একটা মন।
নজরুলকে দেন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র (২৯ আগস্ট ১৯৭৬) ঢাকায় মারা যান আমাদের জাতীয় কবি। ঢাকা বিশ^^বিদ্যালয় মসজিদের পাশেই রয়েছে তার কবর।
আল্লাহর কাছে দুআ করি আল্লাহ তাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য