সুন্দর একটি সাজানো—গোছানো পরিবারের সন্তান মেহরাব ও মেসবাহ। বয়সের তফাত খুব বেশি নয় মাত্র দু’বছর কমবেশি। বাবা একটি ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। মা বাড়ির কাজ সামলান আর ছেলেদের পড়ালেখায় সময় দেন। সময়টা তখন অগ্রহায়ণ মাস শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। এমনিতেও কাশ্মীরে একটু ঠান্ডা বেশি প্রভাব ফেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব মিল—মোহাব্বত। এক ভাইকে রেখে আরেক ভাই কখনো দূরে বা আলাদা থাকতেই পারে না। খাওয়া, ঘুম, স্কুলে যাওয়া, স্কুলে গিয়ে একই বেঞ্চে বসা¬Ñসর্বদা দু’জন কখনো পৃথক হয় না।
কাশ্মীর সীমান্তের ছোট এক গ্রামে তাদের জন্ম। গ্রামেই তাদের বেড়ে ওঠা। খুব সাহসী দুই ভাই। বুদ্ধির দিক থেকেও কেউ কাউকে হার মানাতে পারবে না। তাদের গ্রামের পরিবেশ যেন এক শান্ত, নীরব—নিঝুম গ্রাম। কিন্তু কেন এতো নিঝুম—নিস্তব্ধ। কেউ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হয় না। কোনো ছেলে মাঠে খেলাধুলা করে না। সবাই কেন নিজ বাড়িতেই আবদ্ধ থাকে। অল্প বয়সী এই ছোট দুই ভাই এগুলো নিয়ে ভাবছে। এক ভাই আরেক ভাইকে বলছে:
: ভাই একটি বিষয় আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
: কী বিষয় ভাই, বল না শুনি?
ছোট ভাই বড় ভাই মেহরাব কে বললো। দেখো ভাইÑআমাদের গ্রামটা কেমন নিস্তব্ধ না, কেউ ঘর থেকে বেড়োতে চায় না, কিন্তু কেন? মেহরাব কিছু সময় চুপ থাকে, বিষয়টি কখনো মাথায় নেয়নি। আসলেই তো! আমাদের গ্রাম এতো নিশ্চুপ কেন? পৃথিবীর আরো কত শত দেশ আছে, তাদের তো দেখি ছেলে মেয়েরা মাঠে খেলাধুলা করে, ঘোরাঘুরি করে, মার্কেটে যায়, বাজারে যায়, বিনোদন করতে যায় কিন্তু আমাদের গ্রামের কেউ কোথাও যায় না কেন? চল ভাই, আম্মুর কাছে গিয়ে এই বিষয়ে আজকে জানবো।
পাশের রুম থেকে ছুটে আসে দুই ভাই আম্মুর রুমে। আম্মুর পাশে এসে বসে দুই ভাই। ছোট ভাই মেসবাহ বলতে শুরু করলো; আম্মু আজকে আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে আপনার কাছে, আমাদের উত্তর দিতে হবে। কী? বলো বাবা শুনি, মেসবাহ বড় ভাই তুমি বলো। মেহরাব বলতে শুরু করলো; আম্মু আসলে পৃথিবীর অন্য অন্য কত দেশ, শহর গ্রাম আছে। আমাদের মত কত শত ছেলে মেয়ে আছে। তারা তো স্কুলে যায়, মাঠে খেলাধুলা করে, ঘোরাঘুরি করে, বাজারে যায়, বিনোদন করতে বিভিন্ন স্থানে যায় কিন্তু আমাদের গ্রামের কোনো মানুষ কেন ঘরের বাইরে বের হয় না? ছেলের এমন প্রশ্ন শুনে মা একটু নিশ্চুপ হয়ে গেল। চোখের চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখে। ছোট ছেলেদের কিভাবে বলবে ঠিক বুঝতে পারছেন না। এতো অল্প বয়সে এদের কে এই বিষয়ে বলা কি ঠিক হবে, এমন একটু দ্বিধা—দ্বন্দ্বে পড়লেন মেহরাব ও মেসবাহর আম্মু সালমা খানম। আসলে বাবা তোমরা এখনো ছোট মানুষ তোমরা আরো বড় হলে তখন জানতে পারবে। পাশে বসা মেসবাহ বলে উঠলোÑনা, আম্মু আজকে বলতে হবে আপনার, আমরা জানতে এসেছি। আম্মু বাধ্য হয়ে বলতে লাগলেনÑআমার বাবা সোনা—মানিকেরা শোনো তাহলে, আমাদের গ্রামের অবস্থা আগে উন্মুক্ত ছিল, ছেলে মেয়েরা একা—একা স্কুলে যেতো, মাঠে খেলাধুলা করতো, সবকিছু ভালো মতোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিনের এক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর থেকে কোনো মা—বাবা তাদের ছেলে—মেয়েকে একাকি কোথাও ছেড়ে দেয় না, স্কুলে সাথে নিয়ে যায়, বাহিরে বাজারে সাথে নিয়ে যায়। কারণ সেই পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা সবার স্মরণে আছে। বলছি শোনো এবারÑসবাই সবার মতো চলছিল, কোনো বাঁধা নিয়ম ছিল না এতো, বিকেল হলেই ছেলে মেয়েরা মাঠে খেলাধুলা করতো, তেমনই একদিন ছেলে—মেয়েরা খেলাধুলা করতে মাঠে যায়, হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায়, হুইসেল বাজিয়ে কী যেন আসছে। কালো মুখোশ পড়া চোখে সানগ্লাস, হাত পায়ে মোজা পরিহিত কাঁধে পিস্তল ঝুলিয়ে জোড়া চারেক লোক মাঠে আসে একটি কভার ভ্যানে। মাঠে খেলাধুলা করা ছেলেমেয়েদের কে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। অনেকেই এগিয়ে গিয়েছিল ছেলেমেয়েদের কে বাঁচাতে, কিন্তু রক্তচোষা পিচাশদের পিস্তল তাদের প্রাণ বায়ু বের করে দেয়। সব ছেলেমেয়েদের কে তারা চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায় একটি বড় কভার ভ্যানে। আজও তাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। কথাগুলো বলতে বলতে সালমা খানমের চোখের কোণে অশ্রু ভির জমেছে। মেহরাব জিজ্ঞেস করেÑমা সেই লোকগুলো কারা ছিল? তারা ছিল আমাদের দেশের রক্তচোষা ভারতীয় সৈনিক, যারা আমাদের দেশকে দখল করতে চায়, তাই তারা ছেলেমেয়েদের কে তুলে নিয়ে যায় কারণ, আগামীতে যাতে আমাদের শক্তি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। তাই আগে থেকেই গোড়া বন্ধ করে রাখতে চায়, নতুন কেউ যাতে বেড়ে না ওঠে।
মা এবার দুই ছেলের হাত ধরে বলতে থাকেÑবাবা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনো। জি, আম্মু বলুন আমরা শুনছি। বাবা তোমরা সাবধানে চলাফেরা করবে, আমাদের অনুমতি ছাড়া কখনও কোথাও যাবে না, লেখাপড়া মন দিয়ে করবে, আমাদের স্বাধীনতা প্রয়োজন আছে। তাই তোমরাই হবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। মনে প্রতিজ্ঞা করে চলবে, যেন এই দেশকে তোমরা মুক্ত করতে পারো। দুই ভাই একসাথে একবাক্যে স্বীকার করে নিল মায়ের সব কথা। প্রতিজ্ঞা করে এই দেশকে তারা স্বাধীন করবে। অন্যায় নিপীড়ন থেকে তাদের গ্রামের মানুষগুলোকে মুক্ত করবে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে দুই ভাই মেহরাব এবং মেসবাহ।
