ইবনে খালদুন বলছি

প্রথম পর্ব

আমি ইবনে খালদুন। আমার কথা তোমরা বড়দের কাছে শুনেছ। যারা এ সমাজ নিয়ে ভাবে, দেশ জাতি ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে, তারা একান্ত মনোযোগে আমাকে ও আমার রচনা পাঠ করে। তোমরা এখনো বড় হওনি। জ্ঞানের শাখা প্রশাখায় তোমাদের এখনো বিচরণ শুরু হয়নি। একদিন তোমরা বড় হবে। জ্ঞানের অলিগলি ঘুরে দেখবে নিবিষ্ট মনে। মস্তবড় জ্ঞানী হবে। তখন তো আমাকে ও আমার রচনাবলী পড়বেই।
শুনেছি তোমরা আমাকে জানতে চাও, আমার সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে চাও। শুনে খুশি হলাম। বড়দের জানতে চাওয়া, তাদের লিখিত কিতাব পড়তে চাওয়া খুব ভালো কাজ। যারা বড় হয় তারা বড়দের শ্রদ্ধার সাথে পাঠ করে।
তোমাদের আগ্রহ শুনে চলে এলাম তোমাদের সাথে পরিচিত হতে। শোন তবে, সে অনেক দিন আগের কথা, স্পেন তখন মুসলিম শাসনের ছয়শো বছর অতিক্রম করেছে। সভ্যতা সংস্কৃতিতে আকাশছোঁয়া উন্নতি করেছে। জ্ঞান—বিজ্ঞানে জগতসেরা খ্যাতি এনেছে। জ্ঞানের নতুন—নতুন শাখায় নতুন—নতুন আবিষ্কারে পৃথিবী তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। তখন খৃষ্টান সমাজ মুসলিম স্পেনের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে দেয়। সম্মুখ যুদ্ধে স্পেনের মুসলিম রাজাদের সাথে জাতিগত বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। প্রলোভন আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিংহাসন দখল করতে থাকে। দীর্ঘদিনের সুখবিলাসে মত্ত মুসলিম রাজা বাদশাগণ তাদের খামখেয়ালি ও স্বার্থপর মানসিকতার কারণে খৃষ্টানদের কাছে কৌশলে হেরে সিংহাসনচ্যুত হতে থাকে। ১২৪৮ ঈসায়ীতে সেভিল ও কর্ডোভার পতন হয় খৃষ্টানদের হাতে। দখলকৃত মুসলিম রাজ্যগুলোতে খৃষ্টানরা মুসলিমদের ঈমান আমলের উপরে হামলে পড়ত। ঘরবাড়ি কেড়ে নিত৷ এভাবে ধীরে ধীরে মুসলিম রাজাদের গাফলতির কারণে স্পেনের বৃহৎ অংশ খৃষ্টানদের দখলে চলে যায় এবং স্থানীয় মুসলিমগণ অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। স্পেনের মুসলিম শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস, উত্থান পতনের আনন্দ বেদনার ইতিহাস তোমরা ধীরে ধীরে জানবে একদিন।
ছোট্ট বন্ধুরা, এই যখন স্পেনের পরিস্থিতি, তখন ১৩৩২ খৃষ্টাব্দের ২২ মে আফ্রিকার তিউনিসে আমার জন্ম। ইবনে খালদুন নামে আমার জগত জোড়া খ্যাতি থাকলেও এটা মূল নাম নয়। আমার নাম আব্দুর রহমান। সমসাময়িক জ্ঞানী ব্যক্তিগণ আমার পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে উপাধি দিয়েছে ‘ওলীউদ্দীন’ আর আমার ডাকনাম ‘আবু যায়েদ’। আরব বংশদ্ভূত হিসেবে ‘আল হাযরামী’ ও স্পেনে বাপ দাদার বসবাসের জায়গার দিকে ইঙ্গিত করে ‘আল ইশবীল’’ ডাকে লোকে। পিতার নাম মুহাম্মদ। দাদার নামও মুহাম্মদ। তোমরা এত আশ্চর্য হবে হয়ত। কিন্তু বড় হয়ে কিতাব পড়লে দেখবে, আরব ও অনারব মুসলিম মনীষীদের অনেকের পিতাপুত্রের একই নাম। এটা তাদের ঐতিহ্য। এবার তাহলে আমার পুরো নাম লক্ষ্য কর, ওলীউদ্দীন আবু যায়েদ আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আল হাযরামী আল ইশবীলী।
এবার একটুখানি আমার বংশীয় পরিচয় জেনে নাও। আমার বংশ মহান সাহাবী ওয়ায়েল ইবনে হুজর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে মিশেছে। হিজরি দ্বিতীয় শতক মোতাবেক ঈসায়ী অষ্টম শতকে যখন মুসলমানগণ মহাবীর তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন জয় করে তখন আরব থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে দলে—দলে মুসলমান স্পেনের সমুদ্র তীরে এসে হিজরতের জাহাজ নোঙর করতে থাকে। আমার পূর্বপুরুষগণ সেই কাফেলার সাথে মহৎ উদ্দেশ্যে মাতৃভূমি ইয়েমেন ছেড়ে আসে। দক্ষিণ পশ্চিম স্পেনের কারমোনায় প্রথমে বসতি গড়ে। পরে সেভিলে তারা বসবাস শুরু করে। একপর্যায়ে সেভিলের স্থানীয় পরিবারগুলোর একটি হয়ে যায়। পূর্ব থেকেই আমার বংশের নানাবিধ জ্ঞান গরিমা ও রাজনৈতিক সুখ্যাতি ও অভিজ্ঞতা ছিল৷ স্পেনে এসেও স্থানীয় শিক্ষা ও রাজনৈতিক উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্পেনে আসার পরবর্তী চারশো বছর উমাইয়া, আলমোরাবিয়া ও আলমোহাদ রাজবংশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করে আমাদের পরিবার। পরিবারের অনেক সদস্য সেনাবাহিনীতে কাজ করত৷
তোমরা ইতিহাসের পাতায় ঐতিহাসিক জাল্লাকার যুদ্ধের কথা পড়বে। যুদ্ধটি ছিল স্পেন পুনর্দখলের জন্য মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করতে থাকা খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে। তখনকার মুসলিম বাদশাহ সহযোগিতার জন্য আমন্ত্রণ জানায় আফ্রিকার ইতিহাসের এক মহানায়ক, মোরাবিত সাম্রাজ্যের অপ্রতিরুদ্ধ সম্রাট ইউসুফ বিন তাশফিনকে। ইউসুফ বিন তাশফিন খৃষ্টান রাজা ষষ্ঠ আলফনসোর সাথে জাল্লাকায় এক রক্তক্ষয়ী বাচামরার লড়াইয়ে ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ে। আল্লাহর অশেষ রহমতে ইউসুফ বিন তাশবিনের যুদ্ধ কৌশলে খৃষ্টান বাহিনি ধরাশয়ী হয়। কয়েক শতকের জন্য থেমে যায় তাদের স্পেন দখলের অগ্রাভিযান। ১০৮৫ ঈসায়ীতে সংঘটিত জাল্লাকার এই যুদ্ধে আমার বংশের অনেকেই শাহাদাত বরণ করেন।
উপরে এ কথা তোমাদের বলেছি, আমার জন্ম হয়েছে এমন এক সময়, যখন স্পেনের মুসলিম শাসনের দীর্ঘ ছয়শো বছর অতিক্রম করে গেছে এবং মুসলিম শাসকদের অবহেলা অদূরদর্শী ও গোলামির কারণে স্পেন প্রায় মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মুসলিম স্পেনের এই অধঃপতনের যখন শুরু অর্থাৎ আমার জন্মের আরও একশো বছর আগে আমার দাদার দাদা ১২৪৮ সালে স্পেনের সেভিল ও কর্ডোভার পতনের আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার মরক্কোর উত্তর তীর সাবাতায় (তিউনিসিয়ার কাছাকাছি) গিয়ে বসবাস শুরু করেন। স্পেনের আগত দূর্দশা উপলব্ধি করে তখন আরও বহু মানুষ স্পেন ছেড়ে চলে আসে।
আমার দাদার দাদা, হাসান ইবনে মুহাম্মদ। তিনি এখানে এসে কিছুদিন এখানকার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। পরে তিউনিসের হেফসি সাম্রাজ্যের সম্রাট আবু জাকারিয়ার রাজ দরবারে যোগ দেন। যোগ্যতা দিয়ে সম্রাটের আস্থাশীল পরিণত হন। তাকে জায়গীর দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে রাজ পরিবারের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ফলে সম্রাট আবু জাকারিয়ার শাসনামলেই তার ইন্তেকাল হলে তার পুত্র আবু বকর হেফসি সাম্রাজ্যের ‘ সাহিবে আশগাল’ অর্থাৎ অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। আমার দাদার পিতা হেফসি সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী আবু বকরের এই উচ্চপদ ও নানা গুণের কারণে বংশের খ্যাতি নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে। আবু বকর প্রভূত জ্ঞানের পারদর্শী ব্যক্তি, বিজ্ঞ কূটনীতিক ও লেখক ছিলেন। সরকারি লেখকদের রীতি—নীতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব তিনি লিখেছিলেন, যা পরবর্তীতে আমার অনেক উপকারে এসেছে। কিন্তু দূর্ভাগ্য তার, আবু উমারা নামীয় এক আমীর হেফসি সম্রাট আবু জাকারিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তখন আবু বকর বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ে অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হন। আল্লাহ তার উপর রহম করুন। পরবর্তীতে তার ব্যক্তিত্ব আমাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে।
আমার দাদা মুহাম্মদ ছিলেন আবু বকরের পুত্র৷ ছিলেন হেফসি সম্রাটের ‘নায়েবে হাজেব’ (সহকারী দ্বাররক্ষী)। আসলে তাকে উচ্চপদ দিতে চাইলেও তিনি নিতে চাননি। কারণ উচ্চপদে ভূষিত তার পিতার নির্মম মৃত্যু তাকে সাধারণ পদে জীবিকা নির্বাহ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তার পদ সাধারণ হলেও বংশীয় আভিজাত্যের কারণে রাজ পরিবার তাকে সম্মান করতো। অবসর জীবনে ৭৩৭ হিজরি মোতাবেক ১৩৩৭ ঈসায়ী সনে তার মৃত্যু হয়।
আমার পিতা মুহাম্মদ। তিনি উচ্চ শিক্ষিত মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন৷ সেনাবাহিনীর উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কুরআন হাদীস তাফসির ফিকাহ ও সাহিত্যে তার দক্ষতা ছিল। ধর্মতত্ত্ব আইন ও আরবি ভাষায় তার আগ্রহ ছিল বেশি। ফলে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে ইস্তফা দেন। কবিতা ভালো বুঝতেন। লোকজন বিতর্কিত বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করতে আসত। আমার মানস গঠনে পিতার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আফসোস, পিতা মাতার স্নেহপরশ দীর্ঘদিন আমার ভাগ্যে জুটেনি। ১৩৪৮—৪৯ ঈসায়ী সনের প্লেগ মহামারিতে মানুষ মরে শহরকে শহর উজাড় হয়ে যাচ্ছিল। এত অধিক পরিমাণ মানুষ মারা যায় যে, এরপর বহু শিল্প—সংস্কৃতি পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। আমাদের অঞ্চলও সেই মহামারির কবলে পড়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। তখন আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মমতাময়ী মা উভয়ই প্লেগ আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। আমার তখন সতেরো বছর বয়স। বড় ভাই পরিবারের হাল ধরেন। কিন্তু একদিকে দীর্ঘ মহামারি আবার আশ্রয় ও ভরসার সকল আশা পিতা মাতা উভয়ই ইন্তেকাল করায় আমাদের পরিবার সংকটের অকূল দরিয়ায় পড়ে।
চলবে…

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

দুঃখিত! এই বিভাগের অন্য কোনো পোস্ট নেই।