এক
অতীতের পাতায় মনযোগী হলেই মনে পড়ে আমার মাকে। মনে পড়ে শৈশব কৈশোরের সেইসব সবুজ সুন্দর দিনগুলো। আমার শৈশব তো কেটেছে মায়ের কোলে, তাঁর গা ঘেঁষে, তাঁর—আঁচলে আঁচলে। চাকরীর সুবাদে বাবা দূরে থাকতেন বলে; যাবতীয় বায়না-আবদার মা’র কাছেই জানাতাম।
পাড়ার ছেলেমেয়েরা কখন কি কিনে খেলো, আজ কোথায় বেড়াতে যাবে, কোথায় মেলা বসবে; এসব খোঁজ পেলে বাড়ির গলি পেরিয়ে উঠোনে গিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মা অনায়সেই আবদারটা বুঝে ফেলে আঁচলের গিঁটে, ড্রয়ারে, কিংবা বিছানার নিচে ভাঁজ হয়ে পড়ে থাকা নোট বের করে হাতে দিলেই; এতোক্ষণ চোখে-মুখে লুকিয়ে থাকা হাসি ফুটে উঠতো। এবার ভাইবোন উল্লাসে ভৌঁ দৌড় দিতাম।
কী শীত, কী গ্রীষ্ম! ফজরের জায়নামাজে বসে মা কুরআন পড়তেন গুনগুনিয়ে। শীতের ভোরে লাল-খয়েরি চাদর জড়ানো থাকতো মা‘র গায়ে। তখন আমরা লেপের ওমে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মা আমাদের মক্তবে যেতে ডাকতেন। আড়মোড়া ভেঙে উঠেই সবুজ কায়দাটা হাতে নিয়ে; এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে সহপাঠীদের জোগাড় করে কুয়াশার ভেতরে নেমে পড়তাম মক্তবের পথে।
দিন শেষে সন্ধ্যা পড়তেই ঘরে আলো জ্বলে উঠতো। আমরা নামতা, ছড়া-কবিতার বই নিয়ে চৌকিতে বসে পড়তাম। মা তখন ধবধবে দানার তসবিহ টিপতে টিপতে আমাদের পাশে এসে পা মেলে বসতেন। বানান করে করে শিখিয়ে দিতেন মজার সব ছড়াগুলো।
খাল-বিল থেকে বর্ষার পানি নেমে গেলে বারবাড়ির আঙিনায় মাটির ঢিবি করে মা সেখানে চাল কুমড়ো, লাউ, শিমের বীজরোপণ করতেন। দিন কয়েক পরেই কী অসম্ভব সবুজ চারা গজিয়ে উঠতো! লকলকে ডগাগুলো বাতাসে নড়তে নড়তে একসময় বাঁশের মাচায় উঠে বসতো। পাতার সম্পদে ভরে গেলে; এবার মাচা থেকে বেয়ে উঠে আম কাঠালের ডালে ডালে ছড়িয়ে পড়তো। যখন ডগায় ডগায় হলুদ শাদা ফুল ফুটে উঠতো; তখন আনন্দে চকচক করে উঠতো মা’র চোখ। দাদি বলতেন—তোর মায়ের হাতে যাদু আছে!
দুই
একটু একটু মনে করতে পারি; তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। কী এক ভীষণ অসুখ করেছিল আমার। আমাকে নিয়ে মায়ের সে কী পেরেশানি পোহাতে হয়েছিল! নিয়ম করে প্রতি মাসে গ্রাম থেকে দূরের শহরে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতেন। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো আমাদের। কোনো কোনোদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো হসপিটালের সীমানাতে।
ভয়ানক এই অসুখ কিছুতেই সেরে উঠছিল না। মেজেতে পাটি বিছিয়ে আমাকে শুইয়ে রেখে; শিথানে বসে তালপাতার পাখায় বাতাস করছিলেন মা। অবুঝ চোখে শুধু দেখে যাচ্ছিলাম মায়ের চুপসে যাওয়া মুখখানা। তখন বুঝতাম না, মায়েরা আমাদের জন্য এতো কষ্ট করেন কেন?
এরপর একদিন গ্রামের ছায়া-নিবিড় মক্তব, মায়ের আদর, গ্রাম্য রোদ-বৃষ্টি, পরিচিত পথঘাট, চেনা মানুষ, চেনা হাসি আর বানের নতুন ঘোলাজলে ভেলায় ভেসে কাটানো শৈশবের উৎসবমুখর জীবন ফেলে শহুরে জীবনে চলে এলাম। তখনকার দিনে ছুটি শেষে ফেরার সময় মা অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতেন। পেছনে তাকিয়ে দেখতাম এখনো দূরে দাঁড়িয়ে মা আঁচলে ঘনঘন চোখ মুছছেন। ক‘দিন পড়ায় মন বসতো না কিছুতেই। মাকে ভাবতে ভাবতে দেখতাম বারান্দা জুড়ে নেমে এসেছে সন্ধ্যা ।
মা বেঁচে আছেন বলে পৃথিবী এতো সুন্দর, এতো সবুজ মনে হয় আমার। মাঝেমাঝে মায়ের অসুস্থ হয়ে পড়ার দুঃসংবাদ মন খারাপ করে তোলে। তখন একাকি ভাবতে থাকি, আমার ভুলোমনা মায়ের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মুহূর্তের কষ্টের ঋণ; আমি কী কোনদিন শোধ করতে পারব?