পল্লীকবির ‘নিমন্ত্রণে’ একদিন – জহির উদ্দিন বাবর

পল্লীকবির ‘নিমন্ত্রণে’ একদিন – জহির উদ্দিন বাবর

সেদিন ছিল ৩০ নভেম্বর ২০২৩। ফরিদপুরে এসেছি অন্য একটা কাজে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ট্রেনে সময় লেগেছে মাত্র দুই ঘণ্টা। কাজ সেরেও হাতে কিছুটা সময় রয়ে গেছে। আমরা দুজন। ভাবছি, কী করা যায়! এমন সময় মাথায় এলো, পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের বাড়ি তো এখানেই। এতো কাছে এসে কবির বাড়িটি না দেখে কীভাবে যাই! যেই ভাবা সেই কাজ! একটি অটোরিকশায় চড়ে বসলাম কবির বাড়ির উদ্দেশে।
শহর থেকে প্রায় ৩০ মিনিটের পথ। শহরের বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট পথ ধরে এগোতে থাকল অটোরিকশা। সকালের সূর্যটা তখনও তেতে ওঠেনি। কুমার নদের নির্মল হাওয়া খেতে খেতে নদীর পাড় ধরে এগিয়ে গেলাম। সকাল ১০টার দিকে পৌঁছলাম পল্লীকবির বাড়ির গেটে। এটি এখন আর শুধু বাড়ি নয়, জাদুঘর। ভেতরে ঢুকতে ২০ টাকার টিকিট কাটতে হয়। আমরাও দুটি টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম।
পল্লীকবির ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতাটির কথা মনে আছে? গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেই কবিতায় কবি আকুল আবেদন জানিয়েছেন। নিজের গ্রামে করেছেন নিমন্ত্রণ। লিখেছেন:
‘তুমি যাবে ভাই-যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়।’
আমরা যেন কবির সেই নিমন্ত্রণেই ছুটে এসেছি এখানে।
ঠিক রাস্তার পাশেই বাড়িটি। অন্য পাশে বড় খোলা জায়গায় ‘জসীম মঞ্চ’। পাশেই মৃতপ্রায় কুমার নদ। এক সময় এই নদ ছিল খরস্রোতা। শৈশবে কবির দুরন্ত সময় কেটেছে এই নদকে ঘিরে। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে কবির জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে এখানে অনুষ্ঠিত হয় ‘জসীম মেলা’। বাড়ির প্রবেশমুখেই রয়েছে পল্লীকবির একটি ম্যুরাল। নিচে লেখা রয়েছে-
‘আমার বাড়ী যাইও ভ্রমর; বসতে দিব পিঁড়ে
জলপান যে করতে দিব; শালি ধানের চিড়ে।’
বাড়ির প্রবেশমুখেই কবির কবর। উঁচু বেদীতে চারপাশে নানান রকম ফুলগাছ লাগানো। বাড়ির দিকে এগোতেই কবির বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতায় চোখ আটকে গেল। পাশেই ‘জসীম জাদুঘর’। ২০০৩ সালে ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে কবির স্ত্রী মমতাজ জসীমউদদীন এই জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন।
জাদুঘরের ছোট কক্ষে অনেক কিছু রাখা আছে। কক্ষের সামনের দিকেই বড় বড় বর্ণে লিখে টাঙানো কবির নিমন্ত্রণ, প্রতিদান, আসমানীসহ আরও কয়েকটি কবিতা এবং বেশ কিছু জনপ্রিয় গান। পাশের একটি কক্ষে রয়েছে ‘নারী-নকশী কাঁথা কেন্দ্র’। বাড়ির চারদিকে তিনটি টিনের ঘর, মাঝে উঠোন। উঠোনের এক কোণে রান্নাঘর। অন্যদিকে ঢেঁকিঘরটি এখনো অক্ষত। চারপাশে নানা গাছগাছালি বাড়িটিকে ঘিরে আছে। ছায়া নিবিড় পরিবেশ। কোনো কোলাহল নেই। শহরের অনেকেই একান্তে সময় কাটাতে ছুটে আসেন এখানে। বাড়িটিতে একটা ছোট নামাজঘরও আছে। গাছের ছায়ায় কেউ দোল খেতে চাইলে সে ব্যবস্থাও রয়েছে। এই বাড়িতেই কবি কাটিয়েছেন প্রায় ৩২ বছর। বাড়ির প্রতিটি ধূলিকণায় যেন লেগে আছে কবির স্মৃতি।
আমরা আগ্রহ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম কবির স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন কক্ষ। বাড়ির উঠোন ঘিরে চারটি ঘর। কবির ঘরের ডান পাশে তাঁর বড় ভাই, এরপর সেজো ভাই আর বাম দিকে রয়েছে কবির বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের ঘর। এখন আর তাদের কেউই এখানে থাকেন না। কবিও শেষ জীবনে পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই থাকতেন। বাড়িতে ছোট-বড় আরও কয়েকটি ঘর রয়েছে। কোনোটি রান্নাঘর, কোনোটি ঢেঁকিঘর। কবির ঘরসহ প্রতিটি ঘরে সাজানো রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্র, পুরস্কার, মেডেলসহ নানা স্মৃতিচিহ্ন। একটি ঘরে আছে কবির ব্যবহৃত ঘড়ি, ক্যামেরা, গ্রামোফোন ও টাইপ রাইটার।
ঘরে ওঠার সিঁড়িতে ফুলের টব সাজানো। কক্ষগুলোর সামনে কবির বিখ্যাত কবিতার দুই/তিন লাইন করে লেখা। কক্ষের ভেতর আলমারিতে রাখা কবির বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ, হাতে লেখা বই, চিঠি, স্মারক ডাকটিকিট। পল্লীকবিকে জানতে হলে এই বাড়িতে আসতেই হবে।
কবির বাড়িতে এদিক-সেদিকে টাঙানো রয়েছে নানা স্মৃতিময় ছবি। কবি পরিবারের সদস্যদের বাইরেও অনেকের সঙ্গে কবির ছবি শোভা পাচ্ছে দেয়ালে দেয়ালে। নানা বয়সের স্মৃতির খোঁজ মিলে এসব ছবিতে। বিদেশ ভ্রমণের দুর্লভ ছবিগুলোও রাখা আছে সযতনে। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পল্লীকবির একাধিক ছবি দেখলাম। কবির জীবনের শেষ ছবিটিও রাখা আছে দেয়ালে।
দেখতে দেখতে বাইরের দিকে লোক সমাগম বাড়তে শুরু করেছে। রোদের তীব্রতাও বেড়ে গেছে ততক্ষণে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আরেক বার পুরো বাড়িটি দেখে নিলাম। এবার ফেরার পালা। জিয়ারতের জন্য কবির কবরের সামনে দাঁড়ালাম। মনে পড়ে গেল বিখ্যাত কবিতা- ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’ ঠিক কবিও ৪৭ বছর ধরে প্রিয়জনদের নিয়ে ডালিম গাছের তলে শুয়ে আছেন। আমরাও তাকে দুই নয়নের জলে শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও স্মরণ করি। তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি।

কে ছিলেন পল্লীকবি?
পুরো নাম জসীম উদ্দীন মোল্লা। মোল্লা তাঁর বংশীয় উপাধি। তবে ‘পল্লীকবি’ উপাধিকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন। সেটাতেই তিনি গর্ববোধ করতেন। তাঁর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯০৩, ফরিদপুরের অম্বিকাপুর গ্রামে। জসীম উদ্দীনের বাবার নাম আনসার উদ্দীন মোল্লা। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। মা আমেনা খাতুন। ছিলেন গৃহিণী। নকশি কাঁথা ও নকশি পিঠা তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন।
জসীম উদ্দীনের পড়ালেখাটা শুরু হয় অম্বিকা মাস্টারের পাঠশালায় ভর্তির মধ্য দিয়ে। এর কিছুদিন পর এই পাঠশালা ছেড়ে ফরিদপুরের ‘হিতৈষী মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ ভর্তি হন। তাঁর বাবা এই বিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করতেন। সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর ভর্তি হন ফরিদপুর জেলা স্কুলে। সেখান থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে তিনি আই.এ. পাস করেন এবং একই কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। জসীম উদ্দীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডিয়ান ভার্নাকুলার বিভাগ থেকে বাংলা ভাষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে অষ্টম স্থান অধিকার করে এম.এ পরীক্ষায় পাস করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে জসীম উদ্দীন ড. দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ অ্যাসিট্যান্ট পদে যোগ দেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দেন। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের প্রকাশনা বিভাগের কর্মকর্তা হন।
১৯২১ সালে মোসলেম ভারত পত্রিকায় জসীম উদ্দীনের ‘মিলন-গান’ নামে কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই পত্রিকায় প্রকাশিত কবির প্রথম রচনা। ১৯২৫ সালে প্রগতিশীল সাহিত্য পত্রিকা ‘কল্লোলে’ জসীম উদ্দীনের বিখ্যাত কবিতা ‘কবর’ প্রকাশিত হয়। সে সময় তার বয়স ছিল ২৩ বছর। ১৯২৭ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় পল্লী ও পল্লীজীবনের কাহিনিগুলো কাব্যরূপে ফুটে উঠেছে।
জসীম উদ্দীনের কাব্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক স্বনামধন্য লেখক তাঁর প্রশংসা করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাব্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন-‘জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব-ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লিখবার ক্ষমতা নেই এমনতর খাঁটি জিনিস তারা কখনোই লিখতে পারে না।’
বিখ্যাত এই কবি তাঁর অতুলনীয় সাহিত্যের জন্য বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৫৮ সালে জসীম উদ্দীন প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার পান। ১৯৬৮ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার উপাধি দেয়। ১৯৭৬ সালে তাঁকে একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। ১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে পান তিনি। তবে ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ কবি মৃত্যুবরণ করেন।

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য