বুলবুলির গল্প- আশিকুল্লাহ তানভীর

বুলবুলির গল্প- আশিকুল্লাহ তানভীর

রাতে খুব বৃষ্টি হলো। দূরের শালবনে হিজল গাছের মগডালে, তিন বাচ্চাকে নিয়ে বুলবুলি দম্পতির সংসার। মা বুলবুলি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ফিসফিসিয়ে বাবা বুলবুলিকে বললো, ‘ওগো, বৃষ্টি তো ক্রমে বেড়েই চলেছে, এখন কি করবে? ঝড়ো-বাতাসের যা উল্টোস্রোত! বাচ্চাগুলোকে কি করে রক্ষা করবে? আমার না ভীষণ অস্থিরতা হচ্ছে’ কথাটা বলতে বলতেই মা বুলবুলির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। বাবা বুলবুলি আঁতকে উঠল, বৃষ্টির ছাঁটে তার ভেজা পালকের ডানাটা মা বুলবুলির চোখের উপর ছুঁইয়ে সাহস জুগিয়ে বললো, ‘আহা, কেন কাঁদছো বলো তো! আমি আছি তো নাকি। আরে বাপু, এই সামান্য বৃষ্টিকে ভয় পেলে চলবে কি করে, খামোখা টেনশন কোরো না তো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাবা বুলবুলি কথাটা বলে থামতেই হঠাৎ এক ধমকা ঠান্ডা বাতাস এসে বুলবুলি-ছানাগুলোসহ তাদের বাসাটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। এদিকে বুলবুলি দম্পতি উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজে ফিরতে লাগল তাদের বাচ্চাগুলোকে। একে তো গহীন বন, তার উপর আষাঢ়ের বাদল মুখর ঘন রাত্রি, যার ফলে গাছপালা, তরুলতা কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। ঠাওর করা যাচ্ছিলো না কোথায় কি আছে। মা বুলবুলি চিৎকার করে বললো, ওগো! সবকিছু যে তছনছ হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। এখন আমি কি নিয়ে, কিসের আশায় বাঁচব!
মা বুলবুলি তার কথাটা শেষ করতে পারলো না, তার আগেই সে বেহুঁশ হয়ে কাদাজল জমা মাটিতে পড়ে গেলো।
তারপর ধীরে ধীরে সকালের সোনা রাঙা রোদ ফুটলো, শান্ত হলো প্রকৃতি। বাবা বুলবুলি জলাশয় থেকে ঠোঁট ভরে জল এনে মা বুলবুলির চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিতেই চোখ মেলে তাকালো সে। তারপর কয়েক মুহূর্ত নির্বাক দৃষ্টিতে মেঘহীন নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে আবারও চেঁচামেচি করতে আরম্ভ করলো মা বুলবুলি। বাবা বুলবুলি সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেললো, কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে দীর্ঘ একটি নিশ্বাস ছেড়ে মা বুলবুলিকে বললো, শোনো, এভাবে হাপিত্যেশ না করে চলো আমরা বরং আমাদের ছানাগুলোকে খুঁজে দেখি, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
স্বামীর কথা শুনে মা বুলবুলি উঠে দাঁড়ালো। তারপর আহত, কাতর কণ্ঠে বললো, চলো তবে, খুঁজে দেখি, পাওয়া যায় কিনা।
মা বুলবুলির কথা শেষ হতেই তারা দুজনে ডানা মেলে দিলো নীল আকাশের শামিয়ানায়। তারা সারা জঙ্গল ঘুরেফিরে শালিক, মৌটুসী, দোয়েল, বাবুই এবং অন্যান্য পাখিদের বাসায় গিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল তাদের বাচ্চাগুলোকে কেউ দেখেছে কিনা। কিন্তু শালিকের মতো সবাই সেই একই জবাব দিলো- না গো দিদি, তা দেখিনি। এখনো ঘর থেকে বের হইনি তো, তবে কর্তা এলে না হয় জিজ্ঞেস করব তোমাদের ছানাদের দেখেছে কিনা। আহা গো! অমন সোনার মতো সুন্দর ছানাগুলোর শেষমেশ এই দশা হলো!
সকলের কাছে এমন হতাশাজনক কথা শুনে নিরাশ হৃদয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির পথ ধরল বুলবুলি দম্পতি। পথে তাদের দেখা হলো দাঁড়কাকের সাথে। কাক মা বুলবুলিকে দেখে ডেকে বললো, ও বুলবুলি দি! কাঁদছো কেন?
মা বুলবুলি কিছু বলার আগেই কিচির মিচির শব্দ করে বাবা বুলবুলি বললো, আর বলবেন না দিদি। কাল রাতে কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে ছানা সুদ্ধ আমাদের খরের বাসাটা কোথায় যে উড়ে গেল, খুঁজেই পাচ্ছি না। সারা জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কোথাও বাদ রাখিনি। কিন্তু তবুও পাইনি গো।
এ কথা শুনে দাঁড়কাক বললো, তাই নাকি গো।
মা বুলবুলি বললো, হ্যাঁ, দিদি।
আরে বলো কি? আমি তাহলে ঠিকই দেখেছি। একবার চলো তো তোমরা আমার সাথে।
এ বলেই দাঁড়কাক বুলবুলি দম্পতিকে নিয়ে ডানা মেলে দিলো। দেখতে দেখতে সে তাদেরকে নিয়ে চলে এলো বনের শেষ মাথার জনবসতির কাছে, খোলা মাঠে। বাবা বুলবুলি বললো, আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছো কেন কাকদি?
প্রশ্নটার জবাবে দাঁড়কাক ডানা দ্বারা ইশারা করে দেখালো ময়লার স্তূপের দিকে। যেখানে গাদা করা ময়লার সাথে পরে ছিল বুলবুলিদের বাসাটা। বাবা বুলবুলি আর কিছু বলার আগেই দাঁড়কাক বললো, আমি তাহলে যাই গো! ওদিকে আবার ছানাগুলো না খেয়ে আছে সেই গতকাল রাত থেকে। এ বলেই সে সেখান থেকে চলে গেল।
মা দাঁড়কাক চলে যেতেই বুলবুলি দম্পতি দৌড়ে গেল তাদের বাসাটার দিকে। মনে হলো যেন মরুচারী জলের উৎস খুঁজে পেয়েছে। মা বুলবুলি তার ঠোঁটের আগা দিয়ে বাসাটা উল্টো করতেই দেখতে পেল, দুটি বাচ্চা হাঁ করে এখনো কিচিরমিচির করছে, আরেকটি বাচ্চা নেতিয়ে পড়েছে কিছুটা। মা বুলবুলি নেতিয়ে পড়া বাচ্চাটার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতেই বুঝতে পারলো সে আর বেঁচে নেই! বাবা বুলবুলি এই সব কিছু অদূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। সে দুকদম হেঁটে এসে মা বুলবুলির পিঠে তার ডানাটা রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, এখন আর কেঁদে কি লাভ বলো! যা হবার তা তো হয়েই গেছে, কান্নাকাটি বন্ধ করে তার চেয়ে বরং চলো আমরা অন্য বাচ্চা দুটির জন্য খাবার তালাশ করি।
মা বুলবুলি খাবারের খোঁজে নিঃশব্দে উঠে গেল। ঠোঁটের ভিতর করে খাবার নিয়ে বুলবুলি দম্পতি যখন তাদের ছানাগুলোর কাছে ফিরলো তখন দেখতে পেলো সেখানেই একটি অপরিচিত চড়ুই দাঁড়িয়ে আছে। তারা যখন সেখানে গেল চড়ুই অবজ্ঞার স্বরে বললো, ওহ! এগুলো তাহলে তোমাদের ছানা? তা কি এমন হলো বাপু যে গাছ ছেড়ে মাটিতে এসে বাসা বুনলে দুজনে, বন থেকে সকলে তাড়িয়ে দিয়েছে বুঝি?
মা বুলবুলি রাগে কটমট করতে করতে বললো, তেমন কিছুই নয়! তবে গতকাল রাতের ঝড়ে বাসাটা উড়ে এখানে এসে পড়ল আর কি।
মা বুলবুলির কথা শেষ হতেই হো হো করে হেসে উঠলো চড়ুই, হাসতে হাসতে বললো, ‘তোমাদের ভাগ্যের লিখনই এমন! আফসোস, অথচ আমাকে দেখো- পরিশ্রম করে বাসা বুনতে হয় না, মেঘ, রোদ্দুর, বৃষ্টি, এসবকেও করতে হয় না কোনো পরোয়া। খাই-দাই, গল্প করি, গান গাই, উড়ে বেড়াই যেখানে ইচ্ছে। স্বাধীন জীবন যাপন। এদিকে তোমরা মরো রোদের তাপে, ঝড়ো হাওয়ায় আরও নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে… এটুকু বলে আবারও হো হো করে হেসে উঠলো সে। এ কথা শুনে মা বুলবুলি আহত অথচ উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,বাবুই তোমাকে ঠিকই বলেছিল- সন্দেহ কি তাই? কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়। পাকা হোক, তবু ভাই,পরের ও বাসা, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য