ক্ষমা

ক্ষমা

ক্ষমা
আহমাদ যুবায়ের খান

এক.
ইমন ঢাকায় বেড়াতে আসে তার বড় চাচ্চুর বাসায়। তার শখ হয় সাইকেল দিয়ে পুরো শহর ঘুরে দেখার। চাচাতো ভাই রিয়াদের সাইকেল নিয়ে একদিন ঘুরতে বের হয়।
ইমন সাইকেল নিয়ে বাসার একটু অদূরে যেতেই এক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসে। গ্রামের খালি রাস্তায় যেভাবে তুফানগতিতে সাইকেল চলাতো, ঠিক এমন করেই এখানে সাইকেল চালাচ্ছিল। শহরের ব্যস্ততম রাস্তার গতিবিধি সম্পর্কে তার তেমন কোনো ধারণা ছিল না।
ইমন যখন তুফানগতিতে সাইকেল চালাচ্ছিল, আরেক কিশোর রাস্তা পার হচ্ছিল তখন। ইমন ভেবেছিল, তার পৌঁছার আগেই অচেনা কিশোর রাস্তা পার হয়ে যাবে। কিন্তু এমনটা হলো না। সে এতো স্পিডে সাইকেল চালাচ্ছিল যে, মুহূর্তেই সাইকেল অচেনা কিশোরের কাছে পৌঁছে যায়। সাইকেলের সামনের চাকা সোজা কিশোরের ডান-বাহু বরাবর উঠিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অচেনা কিশোর ‘ও আল্লাহ বলে’ রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে। আশপাশ থেকে পথচারীরা দৌড়ে এসে তাকে ধরাধরি করে তুলে দাঁড় করায়।
অচেনা কিশোরের পা একটু মচকে গেছে। দুঃখের কথা, পা মচকানোর সঙ্গে অল্প পরিমাণে চামড়াও খসে গেছে হাঁটুর একটু নিচ থেকে। পিসঢালা রাস্তা, পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চামড়া খসে রক্ত বের হয়ে যায়।
আহত অচেনা কিশোর অনেক ব্যাথা পাওয়া সত্ত্বেও সাইকেল চালক ইমনকে কিছুই বলেনি এতটুকুন বলা ছাড়া—মানুষে ভরপুর এ রাস্তায় এভাবে কেউ সাইকেল চালায়? সামনে থেকে সতর্ক থাকবা ভেবে তোমাকে কিচ্ছু করলাম না। আমার পক্ষে এই এতগুলো মানুষ থাকা সত্ত্বেও তোমাকে ছেড়ে দিলাম।’

দুই
মাঝে তিনটা বছর কেটে যায়। এই দুর্ঘটনা কারোর মনে নেই। না আঘাত পাওয়া অচেনা কিশোরের। আর না সাইকেল চালক ইমন হুসাইনের।

তিন
অচেনা কিশোর এক শহুরে ছেলে। গ্রামে দাদার ভিটা-বাড়ি থাকলেও কোনোদিন সে যায়নি সেখানে। এই কিশোর বয়সে এসে তার শখ তৈরি হয় গ্রামে যাওয়ার। গ্রাম্য আলো বাতাসে একটু পরিচিত হওয়ার। আব্বু আম্মুকে আবদার জানালে তারাও না করেননি, রাজি হয়ে যান। বার তারিখ ঠিক করে একদিন ‘কোনদিন না দেখা’ দাদার ভিটা-বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ির পথ ধরে ইমন।
তখন সময়টা ছিল হেমন্ত ঋতুর। অগ্রাহায়ণের শেষ দিকে। তখন সবাই মোটামুটি ফসল ঘরে তুলে ফেলেছে। তবে কারোর কারোর ফসল এখনও খেতে স্তুপ দিয়ে রাখা। সিদ্ধ করে শুকিয়ে তারপর ঘরে তুলবে।
এক বিকেল। শহুরে সেই কিশোরের স্বাদ জাগে খেতের আইল ধরে হাটার। সময়টা ছিল আসরের পর। কুয়াশা তার শুভ্র চাদরে ঢেকে নিয়েছে খেত-খামারের আশপাশ। একটু দূরকেই মহাদূর মনে হয়, কোনো কিছু দেখা যায় না। ঠিক তখন ঘটে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
খেতে থাকা ধানের স্তুপ থেকে ধান চুরি হয়। ‘চোর চোর’ বলে বাড়ির লোকজন যখন বের হয়ে আসে, চোর টের পেয়ে তত¶ণে আড়াল হয়ে যায় কুয়াশার শুভ্র চাদরে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে আর ধরা যায়নি।
ফসলের স্তুপ থেকে দশ-বিশ হাত দূরে হবে, দুজন সে দিকে গিয়েছিল একটু ভালো করে খোঁজার জন্য। গিয়ে তারা এক কিশোরকে পেল। কেউ চিনে না তাকে। কিশোরকে যেহেতু কেউ চিনে না, ব্যস, চোর হিসেবে তাকেই সাব্যস্ত করে ফেলে। কিশোর শতভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেও তারা তার কথা শুনেনি। তাকে ধরে নেওয়া হয় ধানের মালিকের বাড়িতে। অচেনা কিশোরকে দেউড়ি মুখ অতিক্রম করে যখন বাড়িতে প্রবেশ করাচ্ছে তখন মালিকের ছেলে কোর্সিং থেকে ফিরেছে মাত্র। সমবয়সী কিশোরকে দেখে আকাশ থেকে পড়ল সে। সবাই মিলে তাকে জোর করে টেনে হেঁচড়ে আনতে দেখে আরও বিস্মিত হয়ে ওঠে। কিছু বুঝতে না পেরে উঠোনে টুলে বসা তার আব্বু , মানে ফসলের মালিককে জিজ্ঞেস করে, —আব্বু, এরা সবাই একে এভাবে ধরে আনছো কেন, কী করেছে সে?’
আব্বু বলল, সে চোর। ধান চুরি করতে এসে ধরা পড়েছে।’মালিকের ছেলে বারান্দা থেকে নেমে সবার হাত থেকে তাকে ছাড়িয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বলে—‘অন্যের অসতর্কতার কারণে যেই মানুষ আহত হয়, হাঁটুর চামড়া খসে রক্ত বয়ে যায়, তারপরও সে দূর্ঘটনাকারীকে কোনো গালি পর্যন্ত দেয় না, সে আবার কীভাবে এই ধান চুরি করতে পারে! আব্বু?তোমার মনে নেই আব্বু, তিন বছর আগে তোমার ছেলে ঢাকায় চাচ্চুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে যে কী এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। এবং ঘটনায় আহতজন কিছুই না বলে তোমার ছেলেকে ছেড়ে দেয়!’ এই সেই আহতজন, যাকে তোমরা চোর সাব্যস্ত করেছো। অতঃপর ইমন সমবয়সী শহুরে কিশোরকে সসম্মানে দাদুর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে।

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য