রহস্যময় অতিথি পাখি
জাহিদ বিন হিকমত
প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে যখন শীতের আর্বিভাব তখন শীতের আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়তে দেখা যায়। ওড়ার সময় এদেরকে দেখতে কখনো ধনুকের মতো বাঁকা, কখনো ইংরেজি ভি অক্ষরের মতো ত্রিকোণাকারে আবার কখনো কখনো একগাছি ফুলের মালার মতো মনে হয়। এরাই হলো সেই পাখি। যাদেরকে আমরা আদর করে বলি অতিথি পাখি। এদেরকে কেউ বলে পরিযায়ী পাখি আবার কেউ বলে যাযাবর পাখি। রহস্যময় এদের জীবনযাত্রা, বৈচিত্রময় এদের চাল-চলন। অবাক করার মতো এদের গতিশীলতা।
এরা মূলত সাইবেরিয়া, হিমালয়, আসাম, অস্ট্রেলিয়া, পৃথিবীর উত্তর মেরু, ফিনল্যান্ড, এন্টার্কটিকা, তিব্বতের উপত্যকা, ইংল্যান্ডের নর্থ হ্যামশায়ারসহ অনেক অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। যখন ঐ এলাকার তাপমাত্রা মাইনাস ডিগ্রিতে নেমে আসে, তখন ঐ এলাকা পাখিদের বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তীব্র শীত থাকার কারণে পাখিদের জন্য দেখা দেয় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব এমনকি বিভিন্ন রোগে তারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এমন প্রতিকূল পরিবেশ থেকে বাঁচার তাগিদে হাজার হাজার মাইল দূরে নিজেদের আশ্রয় খুঁজে নেয় অতিথি পাখিগুলো। বসবাসের জন্য তারা দক্ষিণের কম শীতের দেশ বেছে নেয়। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার-পাখিরা নাকি দেহের ইন্দ্রীয়ের সাহায্যে সহজেই বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়ার তারতম্য অনুভব করতে পারে এবং সে অনুযায়ী সেখানে অবস্থান করে। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে অধিক পাখি আশ্রয় নেয় বাংলার বুকে। এ দেশ তখন হয়ে ওঠে তাদের খাদ্য ও জীবনধারণের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
সৃষ্টিগতভাবে এই পাখিদের শারীরিক গঠন খুব মজবুত হয়। যার ফলে তারা গড়ে ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার আকাশসীমা পাড়ি দিয়ে হাজির হয় এই দূরের দেশে। পাখিদের মধ্যে যারা ছোট তাদের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার। আর বড় পাখিরা ঘণ্টায় অনায়াসে উড়তে পারে প্রায় ৮০ কিলোমিটার। দিনে-রাতে এরা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উড়তে পারে। খুব আশ্চর্যের বিষয়, এসব অতিথি পাখি নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে পারে তাদের গন্তব্যস্থান। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব পাখির রয়েছে বংশগত সূত্রে পাওয়া বিশেষ দিক নির্ণায়ক ক্ষমতা। আরো অবাক করা তথ্য জানা যায় যে, এ সমস্ত পাখি উড়ে চলার সময় বিভিন্ন ভূমিচিহ্ন যেমন নদীনালা, পাহাড়, জঙ্গল প্রভৃতি মনে রাখে। পাখিবিদদের মতে, পাখিরা সূর্য কম্পাস, নক্ষত্র কম্পাস এবং অভ্যন্তরীণ ঘড়ির ক্ষমতার মাধ্যমে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে নির্ভুলভাবে এগিয়ে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থানে। আরো মজার বিষয় হলো- দূর-দূরন্তের পথ পাড়ি দিলেও তারা ফিরে গিয়ে ঠিক তাদের বাড়ি চিনে নেয়।
অতিথি পাখিদের মধ্যে শাবাজ এক অদ্ভত কৌশলী পাখি। এ পাখির ছানারা ভয় পেলে মাটিতে শুয়ে পড়ে। এ পাখির মা-বাবা ছানাদের থেকে শত্রুর দৃষ্টি ফেরানোর লক্ষ্যে কিছু দূরে মাটিতে শুয়ে ছটফট করে। এই কৌশল অবলম্বন করে অতি সহজে তারা শত্রু থেকে রক্ষা পায়। অবাক করার মতো বিষয় হলো- প্রজননকালে পুরুষ পাখি মেয়ে পাখিকে আকৃষ্ট করার জন্য আকাশে উড়ে কসরত দেখায়।
ঐক্যবদ্ধ ভাবে ঘুরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে গার্গেনি বা গিরিয়া হাঁস। এরা বসবাস করে ইউরোপ আর এশিয়ার পশ্চিমের দেশগুলোতে। দলবদ্ধতা ছাড়া এরা একমূহূর্তে চলতে পারেনা। দল বেঁধে উড়ে আসে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ছাড়াও এদেরকে অস্ট্রেলিয়াতেও দেখা যায়।
অতিথি পাখিদের মধ্যে বিশেষ একটা স্থান দখল করে আছে হট্টি-টি পাখি। এই পাখির টি-টি-টি ডাক কিন্তু খুবই বিখ্যাত। রাশিয়া আর কাজাখাস্তানে এদের বসবাস। হট্টি-টি পাখি খুবই ভ্রমণ প্রিয়। কতটা ভ্রমণ প্রিয় এ পাখি তা জানলে অবাক হতে হয়। ঐ এলাকায় যখন শীতের প্রভাব বিস্তার করে তখন এই হট্টি-টি পাখি গরম খোঁজার জন্য ছুটে যায় বিভিন্ন দেশে। আগেই বলেছি-পাখিরা দেহের ইন্দ্রীয়ের সাহায্যে সহজেই বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়ার তারতম্য অনুভব করতে পারে। এরা বাংলাদেশে ছাড়াও কিরগিজস্তান, আর্মেনিয়া, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, সুদান, তুরস্ক, ইসরায়েল, ওমান এমনকি ইরিত্রিয়াতেও যায়।
বড়ো গুলিন্দা একটি অতিথি পাখি। অনেকে চেনে ইউরাশিয়ান কার্লিউ নামে। ইউরোপ ও এশিয়ার উত্তরাঞ্চলে বসবাস করলেও এদেরকে বেশি দেখা যায় বৃটেন ও আয়ারল্যান্ডে। যদি ঘুরতে বের হয় তাহলে যায় আফ্রিকা আর ইউরোপ এশিয়ার দক্ষিণে। বাংলাদেশেও তারা ঘুরতে আসে। এরা একটু বেশি মিশুক টাইপের। অনেকের কাছে এটি মিশুক পাখি নামেও পরিচিত।
প্রাণবৈচিত্রের দূত হয়ে আসা এ সমস্ত অতিথি পাখিদের নিয়ে গবেষণা থেমে নেই। জানা যায়, পাখিদের নিয়ে রহস্য পাঁচ কোটি বছর আগের। এই পাখিদের নিয়ে জানার আগ্রহ যেমন পূর্বে ছিল তা এখনো বহমান। প্রকৃতির রুপ বৈচিত্র্যের সাথে সাথে পাখিদের রুপ-সৌর্ন্দয মানুষ যেমন উপভোগ করে তেমন জানার আগ্রহ বাড়ে তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে। আর এই জানার আগ্রহ থেমে না থাকার কারণে চলছে দিনের পর দিন গবেষণা। অদূর ভবিষ্যতে পাখিদের সম্পর্কে হয়তো এমন অনেক অজানা রহস্য উদঘাঠিত হবে যা জেনে আমরা আরো পুলকিত হবো।