বর্ষার ফুল, সৌরভের মিছিল

বর্ষার ফুল, সৌরভের মিছিল

বাংলাদেশের বর্ষা ঘনঘোর বৃষ্টিই নয়, মায়াবী এক ঋতুও। মেঘের জলরঙে আকাশ আঁকে ক্যানভাস, মাটির বুক ভিজে ওঠে, আর সেই ভেজা বুকেই জন্ম নেয় রঙিন বর্ষার ফুল। কেউ ঝরনার মতো ঝরে, কেউ মেঘের মতো মিশে যায় পাতার পল্লবে। গ্রামে, শহরে, খালের ধারে, স্কুল মাঠের কিনারে, বাড়ির বারান্দায়; সবখানে দেখা মেলে এই ঋতুর ফুলের মিছিল। বর্ষার নীরব শিল্পীর সৌন্দর্য মৌমাছি, প্রজাপতি, মানুষের মন সবকিছুরই অংশ। বর্ষার ফুল নিয়ে এই লেখায় আমরা পরিচিত হব ফুল, গল্প, রূপ আর ঘ্রাণ নিয়ে।

কদম
‘কদম ফুল ফুটেছে ওগো/আজ বনফুলের দিন।’
কদম মানেই বর্ষা। কিশোরেরা এই ফুল হাতে নিয়ে কদমগন্ধা গান গায়, মেয়েরা কদমফুল দিয়ে মালা গাঁথে, আর প্রাচীন কবিতায়-কবিতায় এই ফুল যেন বৃষ্টির প্রতীক। গোলাকৃতি, তুলতুলে, গাঢ় হলুদ ও সাদা রঙের এই ফুলের রয়েছে এক অদ্ভুত আকর্ষণ। এর ফুলদানির মতো গঠন, মৌমাছির পছন্দ, এবং জলপছন্দি স্বভাব বর্ষার সঙ্গে এর নিবিড় বন্ধনের কারণ। বিশেষ করে গ্রামের কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যখন বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়ে আর মাথার ওপর কদমফুল ঝোলে, তখন মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
রেইনলিলি
এই ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Zephyranthes। বাংলায় একে বলে ‘বৃষ্টিফুল’ বা ‘রেইনলিলি’। বর্ষার প্রথম বৃষ্টির পরপরই যেন আকাশ থেকে রঙ ঝরে পড়ে, বাগানের ঘাসের কোণে হঠাৎ করে ফোটে এক ঝাঁক সাদা, গোলাপি বা হলুদ ফুল। ছোট, কোমল, একক একক ফুল দেখে মনে হয় একেকটি তারার মতো।
শিশুরা অবাক হয়ে ভাবে, ‘এই ফুল তো গতকাল ছিল না!’ আসলে রেইনলিলির সৌন্দর্য তার আকস্মিকতায়। অল্প সময়েই ফোটে, এবং অল্প সময়েই ঝরে যায়। কিন্তু যতবার বৃষ্টি নামে, ততবার নতুন করে ফিরে আসে।

শাপলা
বাংলাদেশের জাতীয় ফুল ‘শাপলা’ বর্ষায় পুকুরে, ধানখেতে, জলাভূমিতে জীবন্ত পেইন্টিং হয়ে ফোটে। সাদা, গোলাপি, বেগুনি রঙের এই ফুল পানির উপর ভেসে থাকে। এর পাতা গোলাকার, ভেসে থাকা। বর্ষাকালেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। শাপলা ফুল, এখন খাদ্যও। শাপলার মূল বা ‘ঢেঁকুশাক’ গ্রামের রান্নায় ব্যবহৃত হয়। আবার কিছু শাপলা প্রজাতি দিনে ফোটে, কিছু রাতে।
দোপাটি
দোপাটি বা লাজুকলতা এক আশ্চর্য গাছ। পাতা ছুঁলেই গুটিয়ে যায়, আবার একটু পরেই খুলে যায়। বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে গেলে এদের বংশবিস্তার হয় বেশি। এই গাছ বর্ষায় ছোট ছোট গোলাপি বা বেগুনি ফুল ফোটায়। বাচ্চারা দারুণ মজা পায় দোপাটির পাতা ছুঁয়ে দেখে। এদের ফুল দেখতে সাধারণ হলেও এর আচরণ অসাধারণ।
নীলমণি ও জারবেরা
গাঢ় নীল রঙের ছোট ছোট ফুল নিয়ে ‘নীলমণি’ বাগানপ্রেমীদের অন্যতম প্রিয় বর্ষার ফুল। বৃষ্টিতে ভিজে এর পাতায় ও পাঁপড়িতে ঝরে পড়া জলের ফোঁটা যেন ছোট ছোট মুক্তা। পাশেই যদি থাকে জারবেরা, তবে বর্ষার বাগান হয়ে ওঠে রঙিন স্বপ্নলোক। জারবেরা ফুল লাল, কমলা, হলুদ, গোলাপি এমনকি সাদা পর্যন্ত হয়। এগুলো বর্ষায় টিকে থাকতে পারে বলে বাগানপ্রেমীরা এদের বেছে নেয়।
পাথরকুচি ও অপরাজিতা
বর্ষাকালে অনেকেই বাড়ির ছাদে টব-বাগান করেন। সেখানে পাথরকুচি গাছ তার পাতায় জমা পানি ধরে রাখে, আর ফোটে ছোট্ট লাল বা গোলাপি ফুল। অপরাজিতা গাছ বর্ষার ভেজা আবহাওয়ায় দ্রুত বাড়ে ও গাঢ় নীল ফুলে চারদিক রাঙিয়ে তোলে। অপরাজিতা ফুল দিয়ে অনেকে প্রাকৃতিক নীল রঙ তৈরি করে। এমনকি এর আয়ুর্বেদিক গুণও রয়েছে।

বনফুল
বর্ষায় ধান¶েতের ধারে, কাঁচা রাস্তার পাশে বা ফেলে রাখা কোনো মাঠে এমন কিছু ফুল ফোটে যাদের নাম আমরা জানি না। তবু তারা সৌন্দর্য ছড়ায়। কখনো সাদা ছাতার মতো, কখনো হলুদ সূর্যমুখীর মতো, কখনো পাতার আড়ালে লুকানো ছোট ফুল। বৃষ্টির পর শিশুরা কাদা মাড়িয়ে এসব ফুল তোলে, ঘ্রাণ নেয়, খেলায় ব্যবহার করে। এ এক অপার আনন্দ, নাম না জানলেও মুগ্ধতা বিষম। বর্ষার ফুল চোখের আরাম, স্নিগ্ধতা ও মুগ্ধতা। তারা মৌমাছি, প্রজাপতি ও পোকামাকড়ের খাদ্য জোগায়। কিছু কিছু ফুলের মধু মৌচাকে জমে, কিছু ফুল পতঙ্গনাশক হিসেবে কাজ করে, আবার কিছু মাটি শক্ত করে। যেমন কদমগাছ বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া, শাপলা ফুল জলাশয়ের দূষণ রোধে ভূমিকা রাখে। একেকটা ফুল পরিবেশের ভারসাম্য অনেক উপকারী।
বর্ষার ফুল নিয়ে অনেক কিশোর-কিশোরী আঁকে ছবি, লেখে ছড়া। কেউ কদমের গন্ধ মেখে চিঠি লেখে বন্ধুকে, কেউ বৃষ্টির দিনে শাপলার পাতা হাতে নিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে।

নিম্নে একটি শিশুতোষ লেখা ছড়া,
‘বর্ষা এলেই ফুটে ওঠে,
কদম আর রেইনলিলি।
পুকুরপাড়ে শাপলা হাসে,
দোপাটি মেলে খিলখিলি’
এভাবেই বর্ষার ফুল হয়ে ওঠে কিশোর স্বপ্নের রঙতুলি। বর্ষাকাল তো জীবন্ত রঙপেন্সিলের বাক্স। তার প্রতিটি ফুল একটি রঙ। এই রঙ চোখে ও মনের ভেতরও ছড়িয়ে পড়ে। কদমের মায়া, রেইনলিলির চমক, শাপলার শান্তি, দোপাটির লজ্জা, সব মিলে বর্ষা হয় পূর্ণ।
আমরা যারা শহরে থাকি, তারা ছাদে, বারান্দায়, জানালার পাশে এই বর্ষার ফুলগুলো একটু যত্নে রাখলে প্রকৃতির সঙ্গে একটা বন্ধন গড়ে ওঠে। আর যারা গ্রামে, তারা প্রতিদিনই বর্ষার ফুলের রাজ্যে হেঁটে বেড়ায়।
চলো, বর্ষার এই ফুলগুলো ভালোবাসি, যত্ন করি, আর তাদের গল্প ছড়িয়ে দিই চারপাশে।

 

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য