তুষার মানব নিয়ে মানুষের রয়েছে অনেক আগ্রহ। হিমালয়ের দুর্গম তুষারবৃত উঁচু এলাকায় নাকি রয়েছে এক রকমের মানবাকৃতির প্রাণী, যাকে আমরা ইয়েতি বা তুষার মানব নামে জানি। তুষার মানবের অস্তিত্বের রহস্য নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। হিমালয়ের দুর্গম তুষারাবৃত উচ্চ প্রদেশের এক ধরণের মানবাকৃতি প্রাণী ইয়েতি বা তুষারমানব। নানাভাবে এদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেলেও বিজ্ঞানীরা এখনো এদের প্রকৃত পরিচয় নির্ণয় করতে পারেননি। তাই বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তুষার মানবেরা এখনো একটি রহস্যাবৃত প্রশ্ন হয়ে আছে।
জানাগেছে দানবাকৃতি ইয়েতিরা নাকি প্রায়ই উচ্চ অঞ্চল থেকে উপত্যকার জনবসতিতে নেমে এসে হানা দেয়। সমতলের মানুষের কাছে ইয়েতির বিশ্বাসযোগ্য খবর প্রথম পৌঁছায় ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে। নেপালের প্রথম ব্রিটিশ রেসিডেন্ট বি.এইচ. হডসন হিমালয় অঞ্চলের অজ্ঞাত এক প্রাণীর বর্ণনা দিলেন যে, এটি নাকি মানুষের মতো সোজা হয়ে হাঁটে, সারা শরীর লম্বা চুলে ঢাকা এবং কোন লেজ নেই। মি. হডসনের বিবরণ তখন খুব একটা সারা ফেলতে পারেনি।
কিন্তু উনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে ইয়েতি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে একদল চৈনিক শিকারী জানায় ইয়েতির কথা। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কর্ণেল সি.কে হাওয়ার্ড বেরী-এর অধিনায়কত্বে তিব্বতের মধ্য দিয়ে এভারেস্ট অভিযানকালে কর্ণেল সঙ্গীদের নিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় বিশহাজার ফুট উপরে খারতা হিমবাহের কাছাকাছি কয়েকটি বিশাল আকৃতির মানুষের পায়ের ছাপের মতো পদচিহ্ন দেখতে পান। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে এভারেস্ট অভিযাত্রী ব্রিটিশ মেজর আলান ক্যামেরন হিমালয়ের হিমরেখার উর্ধ্বে খাড়াই শৈল প্রাচীরের গা ঘেসে সঙ্কীর্ণ পথে সারিবদ্ধ মানবাকৃতি প্রাণীর একটা দলকে মন্থর গতিতে চলতে দেখেছিলেন।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ অভিযাত্রী ফ্রাঙ্ক স্মিদি তিব্বত গিয়ে ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে এই প্রাণীর অতিকায় পদচিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি পদচিহ্নগুলোর মাপ নিয়ে দেখেছিলেন সেগুলো লম্বায় ছিল প্রায় ১৩ ইঞ্চি আর চওড়ায় ছিল প্রায় ৫ ইঞ্চি। ১৯৫০ খ্রিঃ নেপালের প্যাঙবোচি অঞ্চলে একটা মমীকৃত হাতের তর্জনী আর খানিকটা চামড়া পাওয়া গেলেও বিজ্ঞানীরা তা পরীক্ষা করে ইয়েতি জাতীয় প্রাণীর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেন। ১৯৫১ খ্রিঃ এক হিমালয় অভিযাত্রী এরিক শিপটন একই ধরণের পদচিহ্ন দেখতে পেয়ে তার ছবি তুলে নিয়ে আসেন এবং সংবাদপত্রে সেই ছবি ছাপা হলে পৃথিবীতে আরো একবার আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই ছবি দেখে বিজ্ঞানীরা নানা যুক্তি দেখালেও তখন তেমন কোনো সিদ্ধান্তে তারা আসেননি।
১৯৫৮ খ্রিঃ নাগাদ পাওয়া গেল ইয়েতি নামক রহস্যজনক তুষারমানবের অস্তিত্বের অবিসম্বাদিত প্রমাণ। ডক্টর নরম্যান ডাইরেনফার্য নামে একজন আমেরিকান তথ্যানুসন্ধানী এবং মার্কিন অভিযাত্রী মি. ম্যাকনিল-এর আনা বিভিন্ন প্রমাণ থেকে জানা যায় ইয়েতিদের মধ্যে দুটো প্রজাতি আছে, একদল লম্বায় ৮ ফুট এবং আর একদলের উচ্চতা চার ফুটের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীরা এই প্রমাণ উপেক্ষা করতে না পারলেও ইয়েতির সঠিক পরিচয় নির্ণয় করতে পারলেন না।
১৯৬২ সালে এভারেস্ট বিজয়ী এডমন্ড হিলারিও পর্বতারোহন কালে নেপালের পূর্ব প্রান্তে মাকালু এবং রোলওয়ালিং পর্বতশৃঙ্গে তুষারের গায়ে ইয়েতির পদচিহ্ন দেখতে পেয়ে ছিলেন। ১৯৬৪ খ্রিঃ এর অভিযাত্রী পিটার টেলর এর বিস্ময়কর আবিষ্কার ইয়েতির বিশালাকৃতির পায়ের ছাপ। আকৃতিতে যেগুলো ছিল কুকুর জাতীয় কোন চতুষ্পদ প্রাণীর পায়ের ছাপের মতো। কিন্তু হিমালয় অঞ্চলে এখনো পর্যন্ত ইয়েতির কোন মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়নি। হিমালয় ছাড়াও পৃথিবীর প্রায় সকল দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলেই ইয়েতির মতো প্রাণীর অস্তিত্বের খবর পাওয়া গেছে। ইয়েতিদের সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনা ও প্রমাণ পাওয়া গেলেও এদের প্রকৃত পরিচয় এখনো অজ্ঞাত রয়েছে। হিমালয় থেকে রকিজ পর্যন্ত এবং গোবি মরুভূমি থেকে দক্ষিণ ইলিয়ন পর্যন্ত ইয়েতি দানবদের রহস্য আজ পর্যন্ত অমীমাংসিত।