কোনএক ব্যস্তশহরে বসবাস করতেন একদম্পতি। তাদের একমেয়ে আর একছেলে ছিল। সে দম্পতির পুরুষমানুষটি মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন। তিনি একজন সৎ এবং নেককার মানুষ ছিলেন এবং তার স্ত্রীও অনেক ধার্মিক এবং পর্দাশীল নারী ছিলেন। তাদের মেয়ের বয়স ছিল সাতবছর এবং ছেলের বয়স ছিল মাত্র আটমাস নয়দিন। তারা বেশ সুখী পরিবার ছিল। প্রতিদিনই দুপুরে খানা খাওয়ার উদ্দেশ্যে হুজুর বাসায় আসতেন। তার স্ত্রীও প্রতিদিনের মতো খানা তৈরি করে সাজিয়ে রাখতেন।
তেমনি একদুপুরে হুজুর খানা খাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসায় এলেন, তার স্ত্রী হুজুর আসার পূর্বেই খানা পরিবেশন করে রেখেছিল। হুজুর মাদরাসা থেকে এসে হাত-পা ধুঁয়ে খেতে বসে গেলেন, কারণ দুপুরের খানার পরে তাকে আবার দ্রুত মাদরাসায় যেতে হবে। তার বড়মেয়ে এসে তার পাশে বসলো এবং আজ সারাদিন তার মেয়ে কি কি শিখল তা বাবাকে বলছে। আরো নানা গল্প করছেন বাবা-মেয়ে। হুজুরের স্ত্রী তাদের কথা শুনতে শুনতে হাতের কাজগুলো শেষ করছিল আর তাদের ছেলে ঘুমাচ্ছিল।
কিছু সময় পরে হঠাৎ কেউ দরজায় এসে জোরে ধাক্কা মারলো, শব্দ পেয়ে তারা জিজ্ঞাসা করলো কে? কিন্তু দরজার ওপাশ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে হুজুরের মেয়ে আবার বললো কে এসেছেন? বাবার খানা এখনো শেষ হয় নাই।
কারণ তার মেয়ে মনে করছিল প্রতিদিনের মতো তাকে ডেকে নিতে মাদরাসা থেকে কেউ এসেছে, কিন্তু হুজুরের উপস্থিতির কথা শুনে কেউ দৌড়ে পালিয়ে গেল। এতে হুজুরের মেয়েও বাইরে চলে গেলো। হুজুরের স্ত্রীও নিজেরমতো কাজ করছিল, কিন্তু হুজুর খেতে খেতে ভাবছিল যে, এমন বেয়াদবি করার মতো সাহস তো তার কোন ছাত্রের নেই, তাহলে কে এমন করে দরজার শব্দ করে কথা না বলে চলে গেলো।
হুজুর তাড়াতাড়ি খানা শেষ করে মাদরাসায় চলে গেলেন।
প্রতিদিনের মতো হুজুর রাতে বাড়ি ফিরলে সবাই একসাথে খানা শেষকরে ঘুমিয়ে পড়লেন। এরপর থেকে প্রতিদিন দুপুরে হুজুর খানা খাওয়ার সময় দরজায় কড়া নাড়ে, কিন্তু প্রশ্ন করলে কোন উত্তর আসে না। হঠাৎ একদিন দুপুরে খানা খাওয়ার সময় আবার দরজায় ধাক্কা দিল, এবার অনেক জোড়ে দরজায় কড়া নাড়লো, আজকের এতো জোড়ে শব্দ শুনে হুজুর বেশ রেগে গেলেন এবং কোন কথা না বলে সরাসরি দরজা খুললেন, কিন্তু একি অবাক করা কান্ড! কেউ নেই দরজায়!
হুজুরের বাসা তিনতলায়; তাড়াতাড়ি পালিয়ে বা লুকিয়ে পড়া সম্ভব নয়। পুরো সিঁড়িটা একঅদ্ভূত নিরবতা পালন করছে। হুজুর কিছুটা ভয় পেয়ে যান। তিনি দরজা বন্ধকরে আবার খানাখেতে চলে গেলেন। তার স্ত্রী প্রশ্ন করেন, কে ছিল দরজায়?
হুজুর উত্তর দিলেন- আল্লাহ সব থেকে ভাল জানেন। দোয়া করো আল্লাহর কাছে যেন তিনি আমাদের হেফাজত করেন। আমীন।
তার স্ত্রী আর প্রশ্ন না করে ছেলের কাছে চলে যান।
হুজুর খানা শেষ করে মাদরাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। তবে তিনি আর তার স্ত্রী বড় চিন্তায় আছেন বিষয়টি নিয়ে। আজকে রাতে হুজুর একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরেন এবং খানা না খেয়েই শুয়ে পড়লেন। তার স্ত্রী ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে মেয়েকে খাওয়াতে চলে গেলেন। তিনি ও তার মেয়ে খাবার রুমে বসে আছেন। তার বেশ ভয় করছিল। তিনি ও তার মেয়ে থানা শেষে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন।
হুজুরের প্রতিদিনের মতো তাহাজ্জুত নামাজের জন্য ঘুম থেকে উঠলেন এবং তার স্ত্রীকেও জাগিয়ে দিলেন। এরপর তিনি অজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যান। একরাকাত নামাজ আদায়ের পর উঠে দ্বিতীয় রাকাত নামাজের উদ্দেশ্যে দাঁড়াতেই হঠাৎ কেউ ফুটন্ত গরম পানি তার পিঠে ঢেলে দিলো। তিনি ভাবলেন তার স্ত্রী গরম পানি নিয়ে হয়তো পড়ে গিয়েছেন এবং পানিগুলো এসে তার শরীরে পড়েছে। তিনি রেগে নামাজ ছেড়ে পিছনে ফিরলেন এবং বলতে থাকলেন- একটু সাবধানে কাজ করতে পারো না? পিঠ তো জ্বলছে আমার। কিন্তু দেখতে পেলেন তার স্ত্রী নামাজ পড়ছে আর কোন পানি নেই কোথাও। তিনি কিছুটা অবাক হলেন। কিন্তু তার পিঠ জ্বলে যাচ্ছে।
এরইমধ্যে ফজরের আজান হয়ে গেলো। ফজরের নামাজ আদায় করে স্ত্রীকে ডাকেন এবং বলেন, দেখতো আমার পিঠে কি হলো? বেশ জ্বলে যাচ্ছে।
তার স্ত্রী পিঠের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে এক চিৎকার দেন এবং কান্না শুরু করেন। তা দেখে হুজুর অবাক হয়ে বলেন- কি হয়েছে কাঁদছো কেন?
তার স্ত্রী বলেন, আপনার পিঠ তো পুড়ে ফোসকা পড়ে গেছে।
তা শুনে হুজুর কিছুটা ভয় পেলেন। কিন্তু স্ত্রীকে কিছু বুঝতে দিলেন না। তিনি কোন কথা না বলে মলম লাগিয়ে শুয়ে পড়লেন। এরপর থেকে শুরু হলো তাদের বাসায় নানা ধরণের সমস্যা। এক রাতে সবাই ঘুমাচ্ছেন। মাঝরাতে শুনতে পেলেন কাচের জিনিস ভাঙ্গার শব্দ। তারা ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলেন, কাচের জিনিসগুলো এমনি উপর থেকে নিচে পড়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও কেউ নাই। তারা অনেক ভয় পান এবং আস্তে আস্তে দোয়া পড়তে থাকেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয় না। এরপর তারা শব্দ করে দোয়া পড়তে থাকলে সবকিছু আস্তে আস্তে থামে।
এরপর থেকে যে যখনই নামাজ পড়তো বা কুরআন তিলাওয়াত করতে বসতো তাদের সাথে নানা ধরণের অত্যাচার করতো কোন অলৌকিক শক্তি। কখনও চুল ছিঁড়ে ফেলতো, গরম পানি ফেলতো ইত্যাদি। একবার ছেলেকে রেখে তার স্ত্রী নামাজ পড়তে দাঁড়ান। হঠাৎ শুনতে পান তার ছেলে ভয়ংকরভাবে চিৎকার করে কান্না করছে। তিনি দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দেখতে পেলেন ছেলের পিঠের চামড়া ছিঁড়ে কেউ গোশত তুলে নিয়েছে।
এই দেখে হুজুরের স্ত্রী অনেক ভয় পান এবং স্বামীকে বলেন, তিনি আর এ বাসায় থাকবেন না। এই বলে হুজুরের স্ত্রী বাচ্চাদেরকে নিয়ে তার বাবার বাসায় চলে যান এবং হুজুরকে ওই বাসায় যেতে নিষেধ করেন।
এরপর তারা ঐ বাসা পরিবর্তন করেন এবং আর কখনো ঐ বাসায় ফিরে যাননি। কিন্তু আজও তারা জানেন না কি হয়েছিল তাদের সাথে। এর কোন ব্যাখ্যা ছিল না হুজুর এবং তার পরিবারের কাছে। হয়তো দরজার ওপাশ থেকে উত্তর না আসার পরেও দরজাটা খোলা ভুল ছিল।