পথশিশু

নাফিজ কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে তুরস্কে তুর্কিমিনিস্তানের সন্ধানে বইটি পড়ছে। তার পাশে টাইপরা একজন লোক ফেইসবুকে ঢুঁ মারছে।
একজন পথশিশু এসে টাইপরা লোকটার পা জড়িয়ে ধরে বলছে, স্যার কইটা টেহা দেন, স্যার দেন।
লোকটা নির্দয়ের মত বলছে- পা ছাড় বলছি। পা ধরে কাঁদলেও টাকা দিবো না।
পথশিশুটা আর পা ছাড়েনি। লোকটা ফেইসবুকে মনোযোগী হয়। হয়ত সে গর্বিত হচ্ছে, কেউ তার পা জড়িয়ে আছে বলে।
পথশিশুর কান্নার আওয়াজ নাফিজের কানে পৌঁছে। নাফিজ তাকিয়ে দেখে, উষ্কখুষ্ক চুল ও ধুলোমলিনের প্রলেপ দেওয়া একটা পথশিশু। তার পাশের লোকটির পা ধরে বসে আছে। অসহায় আকুলতার কণ্ঠে বলছে- আমারে টেহা দেন, কইটা টেহা দেন আমি দুইদিন ধইরা কিছু খাই নাই। শরীলে অনেক জ্বর।
দৃশ্য দেখে নাফিজ বিস্মিত! একজন মানুষ কীভাবে এতো বড় অমানুষ হয়, কীভাবে এতোটা হিংস্র ও অমানবিক হয়। মানুষ যদি মানুষের জন্য হয় তাহলে সে মানুষ এতো বড় অমানুষ কেন। নাফিজ পথশিশুর মাথায় হাত রাখে। চমকে যায়। শিশুটি ভীষণ জ্বর নিয়ে দিব্যি কথা বলে যাচ্ছে, হেঁটে হেঁটে এ বেঞ্চ থেকে ও বেঞ্চ হাত পেতে পেতে প্লাটফর্মের মাঝখানে চলে আসে। নাফিজের চোখ দিয়ে অশ্রু বেরুচ্ছে। নাফিজ ছেলেটিকে বলে- জ্বর কতোদিন যাবত?
-তিনদিন।
-ঔষধ খেয়েছো?
-না কে আমাকে ঔষধ কিনে দিবে? আমি জ্বর লইয়া কোন কাম করতে পারি না, কোন কামকাজ করতে পারলে কারো কাছে হাত পাতি না।
নাফিজ ছেলেটিকে ধরে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মসজিদে নিয়ে যায়, বিশ মিনিট ওর মাথায় পানি ঢালে। মাথা হালকা ঠাণ্ডা হয়। ছেলেকে জিজ্ঞেস করে- কী খাবে বলো?
-স্যার কিছুই ভালো লাগে না। খালি রুটি কলা খাইয়া একটা বড়ি খামু। জ্বরটা না কমলে আমি মইরা যাবো।
নাফিজ ওকে কলা রুটির দোকানে বসিয়ে ওর অবস্থা বলে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে আনে।
নাফিজ নিজ হাতে কলা ছিলে রুটি টুকরো টুকরো করে শিশুটির মুখে তুলে দেয়। শিশুটি মায়াভরা চোখ নিয়ে নাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে। এ তাকানোয় আছে ভালবাসা আছে কৃতজ্ঞতা। ওর চোখ দিয়ে টপটপিয়ে পানি পড়ছে। চোখের পানি অনুবাদ করে দিচ্ছে পথশিশুর হৃদয়ের অব্যক্ত কথামালা।
নাফিজের মনে হয় শিশুটি যেন বলছে- ‘আচ্ছা আমরা কি কারো ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়। আমরা কি মা-বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবো। মা-বাবা ভাই-বোনের আদর তো আর আমরা পাই না। আমরা চাই একটু ভালবাসা। একটু করুণা। মানুষ হিসেবে ভালবাসা।
আজকে পশু-পাখিকে মানুষ কত আদর করে, যত্ন করে লালন করে। কিন্তু আমরা মানুষ হয়ে মানুষের কাছ থেকে সেই ভালবাসাটুকু পাই না। আজকে আমরা সুবিধা বঞ্চিত বলে, সবাই আমাদেরকে ভালবাসা বঞ্চিত করে রাখে। আমাদের এই অবস্থার জন্য কারা দায়ী আমরা না আমাদের এ সমাজ ব্যবস্থা? এদেশের অন্য শিশুদের মত আমরা কেন মক্তবে, স্কুলে যেতে পারি না। সুবিধাবাদীরা যদি সুবিধা পায়। তাহলে সুবিধা বঞ্চিতরা কেন পাবেনা? এদেশে তো স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল এদেশের মানুষ সুবিধা বঞ্চিত বলেই। তাহলে সুবিধা বঞ্চিতরা কি সুবিধা পাচ্ছে এদেশে। এই স্বাধীনতার লাল সবুজ শামিয়ানার নিচে বহু মানুষ পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয়ে যন্ত্রণাদায়ক স্বাধীনতা ভোগ করছে।’
নাফিজ ওর চোখের পানি মুছে দেয়- তুমি কোন চিন্তা করো না। তুমি একদমই সুস্থ হয়ে যাবে।
রুটি কলা খাওয়ানোর পর ওকে বড়ি খাওয়ায়। নাফিজ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ০২:২০বাজে। একটু পরেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ছেড়ে যাবে।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য