হুজাইফার রোদনভরা দিন

হুজাইফার রোদনভরা দিন

আজ আব্দুল্লাহ খুব খুশি। বেশ আনন্দিত ও উৎফুল্ল সে। আজ তার একমাত্র সন্তান হুজাইফার নুরানীতে আলিফ-বা-তার প্রথম দিন। আব্দুল্লাহ একজন রিকশাচালক। রিকশা-ই তার উপার্জনের একমাত্র সম্বল। রিক্সা দিয়ে সারাদিন রোদে পুড়ে ঘাম ঝরানো মেহনত করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে সে। ওতে যে কয় পয়সা আয় হয়, তা দিয়েই পরিবারের তিনসদস্য আল্লাহর কৃপায়-অনুকম্পা স্মরণে রেখেকৃতজ্ঞতায় জীবন কাটিয়ে দেয়।
আব্দুল্লাহ নিজে অশিক্ষিত। লেখাপড়ার জন্য বিদ্যালয়ের আঙ্গিনাও মাড়ায়নি। তবে তার মনের দৃপ্ত আশা তার একমাত্র ছেলে বিদ্যা শিখে জ্ঞানে-গুণে অনেক বড় হবে। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যোগ্য দাঈ হবে।
আব্দুল্লাহ প্রথমে পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করল। হুজাইফার শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা কিভাবে করা যায়? কোথায় তাকে ভর্তি করালে উদ্দেশ্য সফলতার মুখ দেখবে? ইমাম সাহেব ছিলেন দ্বীনদার। তিনি আব্দুল্লাহকে সুপরামর্শ দিলেন, ছেলেকে প্রথমে দ্বীনি পরিবেশ সমৃদ্ধ কোন মাদরাসার নূরানী বিভাগে ভর্তি করাতে। নূরানীর লেখাপড়া সমাপ্ত হলে হেফজখানায় দিয়ে দিতে।
ইমাম সাহেবের সুন্দর পরামর্শ আব্দুল্লাহর বেশ পছন্দ হলো। খুব মনে ধরল তার। বিদায় নিয়ে আব্দুল্লাহ ঘরে ফিরে গেল। হুজাইফার মাকে সব কথা খুলে বলল। হুজাইফার মা ছিল বুদ্ধিমতী মহিলা। কালবিলম্ব না করে ইমাম সাহেবের পরামর্শ পালনে আব্দুল্লাহকে প্রণোদনা দিতে লাগল।
আব্দুল্লাহ আদরের দুলাল হুজাইফাকে বাড়ির অনতিদূরে একটি নূরানী মাদরাসায় ভর্তি করে দিল। আজ তার নূরানীতে যাওয়ার প্রথম দিন। আবদুল্লাহর ঘরে যেন আজ বিনা চিঠিতে ঈদ নেমে এসেছে। সবাই খুশিতে বাগবাগ। আনন্দের আমেজে সবাই আহ্লাদিত। আজ হুজাইফা মাদরাসায় যাবে। মাদরাসার নতুন ইউনিফর্ম তাকে পরানো হলো। মা হুজাইফার প্রিয় খাবার তৈরি করে টিফিন বক্সে বেশি করে দিয়ে দিল। আদর সোহাগের ছোঁয়ায় হুজাইফাকে বলে দিল, হাত পরিষ্কার করে আল্লাহর নাম নিয়ে ডান হাতে যেন খাবার গ্রহণ করে। ক্লাসের বন্ধুদেরও যেন খেতে দেয়।
হুজাইফা বাবার রিকশায় চড়ে মাদরাসায় পৌঁছল। কিন্তু একি কাণ্ড! আব্দুল্লাহ হুজাইফাকে মাদরাসায় রেখে রওনা দিতেই সে জুড়ে দিল তীব্র কান্না। জোরালো কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী করে তুলল সে। হুজাইফার এমন তীব্র কান্নায় পরাস্ত হয়ে বাধ্য হয়ে আব্দুল্লাহ তাকে আবার ঘরে নিয়ে আসলো। বাসায় ফিরে আব্দুল্লাহ হুজাইফাকে অনেক বোঝালো। বিদ্যার্জনের নানা উপকারিতা তুলে ধরল। কিছুতেই কিছু হলো না। হুজাইফা কোনোভাবেই মাদরাসায় যেতে রাজি নয়। আব্দুল্লাহ পুত্রকে নিয়ে পড়লো মহা টেনশনে। তার সকল আনন্দ হাওয়ায় উড়ে গেল। মন হয়ে গেল ভীষণ ভারাক্রান্ত। হুজাইফার মায়ের সাথে মত বিনিময় করলো কি করা যায় । আব্দুল্লাহকে সান্ত¦না দিয়ে সে বলল, বাচ্চা ছেলে কয়েকদিন গড়ালে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাকে আপাতত আপন অবস্থায় ছেড়ে দিন। তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।
আব্দুল্লাহ পাঁচওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর হুজাইফার জন্য দু হাত তুলে দোয়া করতে লাগলো। এদিকে হুজাইফা ছিল খেলাধূলায় মত্ত। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তেই সামান্য দানাপানি মুখে পুরেই সে বেরিয়ে পড়তো বাড়ি থেকে। পাড়ার ছেলেদের সাথে আড্ডা, মৌজ-মাস্তিতে দিন কাটিয়ে দুপুরবেলা ঘরে ফিরে আহার করত। এরপর দীর্ঘ নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত। বিকেলে আবার বেরিয়ে পরতো সাঁঝের বেলায় ফিরত।
এভাবেই কাটছিল তার সময়। হঠাৎ একদিন সে প্রতিদিনকার মতো মাঠে গিয়ে দেখতে পেল তার সাথী-সঙ্গীরা কেউ আসেনি। অনেকক্ষণ সাথীদের জন্য অপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে গেল। এভাবে প্রায় সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল। খেলতে আসলো না। হুজাইফা এখন ঘর থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিল। একসপ্তাহ গত হওয়ার পর কেউ এসে হুজাইফার ঘরের দরজা নক করল। দরজা খুলতেই দেখতে পেল তার সঙ্গীরা সবাই মিলে তাকে নিতে এসেছে। হুজাইফা তাদেরকে একসপ্তাহ খেলতে না আসার কারণ জিজ্ঞাসা করল।
তারা জানাল আমাদের স্কুলে পরীক্ষা চলছিল। তাই আমরা পড়ালেখার চাপে একসপ্তাহ খেলতে আসতে পারিনি। এখন আলহামদুলিল্লাহ আমাদের পরীক্ষা শেষ তাই খেলার জন্য চলে আসলাম। হুজাইফা তাদের কথা শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। পরীক্ষা আসলে কি জিনিস তার জানা ছিল না। আজকে এসব কথা প্রথম শুনেছে সে। সাথীদেরকে সে কিছু বুঝতে না দিয়ে নীরবে তাদের সাথে খেলতে চলে গেল। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রাতের খাবার মজলিসে যখন বসল। বাবার কাছে জিজ্ঞাসা করল, আব্বাজান পরীক্ষা এটা কি জিনিস?
আব্দুল্লাহ বলল, যেসব ছেলেরা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, বছরান্তে তাদেরকে পঠিত বিষয় সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়; যাতে করে কে সবচেয়ে ভালো পড়া করেছে তা জানা যায়। আর যারা খুব ভালো পড়া পারে তাদেরকে আকর্ষণীয় পুরস্কার দেয়া হয়।
উপহার উপঢৌকন আর পুরস্কারের কথা শুনে হুজাইফার হৃদয় গলে গেল। সে বাবাকে বলে- আব্বা আমিও কি পুরস্কার আর উপহার পেতে পারি?
আব্দুল্লাহ বলল- কেন নয়? যদি তুমিও বিদ্যালয়ে গিয়ে মন লাগিয়ে পড়াশোনা করো তবে তুমিও পাবে এমন উপঢৌকন। তোমার আম্মা-আব্বু রাজি-খুশি হবেন। আর যে সন্তানের উপর তার আম্মা-আব্বু খুশি হয়ে যায়, আরশওয়ালা আল্লাহ তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। সকল বিষয়ে তাকে মদদ দান করেন।
হুজাইফা খুব অনুতপ্ত হলো। সে তার মা-বাবার আদেশ অমান্য করেছে। মা-বাবার কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে নিল। অঙ্গীকার দিল আর কখনো পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য