রহস্যময় বালক

রহস্যময় বালক

রোজকার মতো স্কুলের পথ ধরে রাফি। রাস্তার পাশেই জলপাই বাগান। সারি সারি জলপাই গাছ। গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। রাফি গাড়ির গ্লাস নামিয়ে উঁকি দেয়। বাগানটা দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। সামনে মরুর বিশাল সমুদ্র। ওটা পার হলেই শহর শুরু। ছোট্ট শহর। শহরের মাঝখানেই ওদের স্কুল। রোজ এ পথ ধরেই রাফি স্কুলে যায়। বাগানটা ওর ভীষণ ভালো লাগে। মরুর বুকে বাগানটা যেন এক সজীব শীতলতার জানান দিচ্ছে।
রাফি গ্লাস উঠিয়ে দেয়। বাগানের সীমানা শেষ। মরু এলাকা শুরু হয়েছে। ওদের গাড়িটা একটা উটকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রাফি ঘাড় ঘুরিয়ে উটের দিকে তাকায়। ওর বয়সি একটা ছেলে উটের উপর বসা। রাফি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা খুব সুন্দর। কিন্তু মলিন কাপড় পরা। মাঝে মাঝেই ছেলেটাকে দেখে রাফি। স্কুলে যাওয়ার পথেই দেখা হয়। গত কয়েকদিন ওকে দেখেছে হেঁটে যেতে। এই লম্বা পথ ও হেঁটে গিয়েছে। খুব মায়া হয় রাফির। আজ একটা উট পেয়ে গেছে। ওদের নিজের কিনা জানে না রাফি। ভালোই হলো। আজ ওর কষ্ট কম হবে। খুব দ্রুত দূরত্ব বাড়ে রাফি আর উটের মাঝে। সোজা হয়ে বসে রাফি।
শহরে ঢুকে পড়েছে ওরা। ছেলেটা ওদের স্কুলেই পড়ে। আজকে ওকে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে? দোটানায় পড়ে যায় রাফি। ছেলেটা মনে হচ্ছে খুব গরিব। মাঝে মাঝেই রাফি ওকে শুকনো রুটি খেতে দেখে। পানিতে ভিজিয়ে শুকনো রুটি খায়। কয়েকদিন আবার ভালো খাবারও খেতে দেখেছে। মনে হয় কেউ ওকে ভালো খাবার হাদিয়া দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলে যদি ও লজ্জা পায়। থাক।
গাড়ি থেকে নেমে পড়ে রাফি। ছোট ছোট পা ফেলে সামনের খালি জায়গা মাড়িয়ে স্কুলে ঢুকে পড়ে ও। একটু পরেই ঘণ্টা পড়বে। রাফি ক্লাসে ঢুকে জানালার পাশে বসে পড়ে। বার কয়েক জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। ছেলেটা এখনো আসেনি। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। একটু পরেই ওর দেখা মিলল। রাফি একটা মুচকি হাসি দিল। এসে পড়েছে ও। উট থেকে নেমে সোজা ক্লাসের দিকে দৌড়।
আচ্ছা কি নাম ওর? আজকে খোঁজ নিতে হবে। এর মধ্যেই ঘণ্টা পড়ল। ছেলেরা যার যার ইচ্ছে মতো বসে পড়ল। ক্লাসের পর ক্লাস চলল। দুপুরে খাবারের সময় রাফি ছেলেটার খোঁজে বের হলো। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে নাম জানা গেল। তাকি নাম ওর। ওর এক ক্লাস নিচে পড়ে। রাফি তাকিকে খোঁজ করে পেয়েও গেল। নিরিবিলি এক জায়গায় বসে খাবার খাচ্ছে। রাফিও খেতে বসল। আড়চোখে কয়েকবার দেখল তাকি কি খায়। আজও শুকনো রুটি খাচ্ছে। তবে রুটির সাথে জয়তুনের তেল। মনটাই খারাপ হয়ে গেল রাফির। কি কষ্ট করে খায় ছেলেটা। বেশ কয়েক ঢোক পানিও গিলে ফেলেছে এর মধ্যে। একবার উঠে গিয়ে ওর খাবার থেকে কিছু দিবে নাকি? যদি লজ্জা পায়। তার আগে ওর সাথে ভাব জমানো দরকার।
যেমন কথা তেমন কাজ। স্কুল ছুটির পর রাফি তাকির পিছু নিল।
এই শোন, কি নাম তোমার?
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তাকি। মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল, তাকি। তোমার নাম…
আমি রাফি। আমি তোমার একক্লাস উপরে পড়ি।
ও আচ্ছা। তাহলে তুমি ভাইয়া।
ফিক করে দুজনেই হেসে ফেলে। একটু পরেই দুজনের ভাব জমে ওঠে। রাফি বেজায় খুশি। তাকির সাথে কিছুটা ভাব জমানো গেল। এখন হয়ত কিছু করতে সহজ হবে।
তোমাকে আমি আজ বাড়ি পৌঁছে দিই। আমার সাথে গাড়ি আছে।
না, না, ঠিক আছে। আমি যেতে পারব। আমার আরেক বন্ধু আছে। ওর সাথে গল্প করতে করতে চলে যাব।
তাহলে তোমরা দুজনেই চল।
আজ না, আমার ঐ বন্ধু হয়ত গাড়িতে যেতে চাইবে না। আমিও আজ গাড়িতে যেতে চাচ্ছি না।
তবে তোমরা যাবে কিভাবে?
কেন! পায়ে হেঁটে। সামান্য পথই তো। গল্প গল্প করতে করতে চলে যাব।
আচ্ছা আজ থাক। আরেক দিন তুমি আমার সাথে যাবে, তোমার বন্ধুও যাবে। ঠিক আছে?
মাথা দুলিয়ে সায় দেয় তাকি।
রাফি দেরি না করে গাড়িতে উঠে পড়ে। তাকি দাঁড়িয়ে থাকে। পাশে এসে দাঁড়ায় ওর সেই বন্ধুটি। দুজনেই তাকিয়ে থাকে গাড়ির দিকে। একটু পরেই দু’বন্ধু মিলে হাঁটা ধরে।

২.
পরের দিন রাফি স্কুলের যাবার পথে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। যদি তাকির দেখা পাওয়া যায়। নাহ, কোনো খবর নেই। পুরো রাস্তায় কোথাও তাকিকে দেখা গেল না। আজ রাফি বেশ কিছু খাবার বাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। দুপুরে একসাথে বসে খাবে তাকিকে নিয়ে। একটা সুন্দর জামাও এনেছে। তাকিকে হাদিয়া দেবে। কিন্তু কোথাও তাকির খোঁজ নেই। আজ মনে হয় ও হেঁটে আসবে। স্কুলে আসার কোনো বাহন আজ হয়ত ওর ভাগ্যে জোটেনি।
মনটাই খারাপ হয়ে যায় রাফির। ও কত সুখে আছে। আর তাকি? দেখতে দেখতে স্কুলে চলে আসে ও। গাড়ি থেকে নেমে ক্লাসের পথ ধরে। আজও জানালার পাশে বসে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। তাকির খবর নেই। আজ কি তাহলে ও স্কুলে আসবে না? এমন তো হয় না। যতদিন রাফি ওকে দেখেছে স্কুল কখনো কামাই দেয়নি তাকি। অসুস্থ নাকি? স্কুলে ছুটির পর ঠিকানা নিয়ে ওকে দেখতে যেতে হবে। ঘণ্টায় বাড়ি পড়ল। ক্লাসের পর ক্লাস চলল। দুপুরের খাবারের সময় তাকিকে দেখে রীতিমতো চমকে উঠল রাফি। ওকে আজ চেনাই যাচ্ছে না। চমৎকার সুন্দর একটা কাপড় পরে এসেছে ও। খাবার নিয়ে বসেনি এখনো। রাফি তাকির কাছে এসে বসে পড়ে।
স্কুলে আসার পথে তোমাকে আজ দেখলাম না।
একটা মুচকি হাসি দিল তাকি।
আজ আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। দু’জনে মিলে খাব। কি বল?
আবারও হাসে তাকি।
হাসছ যে?
আমিও তো তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।
বল কি!
হ্যাঁ, তোমার জন্য আর আমার ঐ বন্ধুর জন্য।
ততক্ষণে তাকির বন্ধুও এসে পড়েছে।
রাফি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তাকি আজ সুন্দর কাপড় পড়ে এসেছে। ওর জন্য খাবারও এনেছে। এটা কি করে সম্ভব। না জানি বেচারাকে এজন্য কত কষ্ট করতে হয়েছে। অযথাই মনে হয় তাকিকে কষ্টে ফেলে দিল রাফি। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছে।
এই ভাইয়া!
চমক ভাঙ্গে রাফির।
খাবার বের কর, সবাই মিলে খাই। আরও দু’জনকে দাওয়াত দেই কি বল? খাবার তো বেশি হবে।
হ্যাঁ, তা করা যায়।
দাওয়াত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও দু’জন বন্ধু এসে বসে পড়ল। এবার খাবারের পালা। রাফি আর তাকির বাটি থেকে একের পর এক ভালো খাবার বেরুতে লাগল। রাফি তো রীতিমতো অবাক। এতগুলো ভালো খাবার এনেছে তাকি। বন্ধুরা মহা উৎসাহে খাবার হাত চালাল।
কিন্তু রাফির মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সবার সামনে তাকিকে বলা যাবে না। স্কুল ছুটির পর তাকে আজ জিজ্ঞেস করবে। তার উপর ওর জন্য আনা কাপড়টাও দিতে হবে।
ভাবনা আর খাওয়া একসাথেই চলল। তারপর যে যার মতো ক্লাসে। যথারীতি ক্লাস। ছুটির ঘণ্টা। যে যার মতো করে বের হচ্ছে। রাফি স্কুল গেটে এসে দাঁড়ায়। একটু পরেই তাকি এসে দাঁড়ায় রাফির পাশে।
তুমি এসে পড়েছ?
হ্যাঁ।
আমি তোমার জন্য একটা হাদিয়া এনেছিলাম। বলতে বলতে কাপড়ের ব্যাগটা তাকির হাতে দেয় রাফি।
আমার জন্য? মুচকি হাসি দেয় তাকি।
তোমার পছন্দ হয়নি?
বারে কেন হবে না, খুব সুন্দর তো! আবারও হাসে তাকি।
হাসছ যে?
এমনি।
বাড়ি যাবে না ভাইয়া?
হ্যাঁ যাব তো।
আজ আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।
তুমি?
হ্যাঁ, আমি। কেন!
ফোঁস করে একটা গাড়ি এসে থামল ওদের সামনে।
চল ভাইয়া আজ তুমি আমার গাড়িতে যাবে।
তোমার গাড়িতে!
হ্যাঁ, কেন! বেশ অবাক হয় তাকি।
তোমার গাড়ি আছে! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রাফি।
আছে তো। হাসতে থাকে তাকি।
তুমি হাসছ?
আমি জানি ভাইয়া, তুমি কেন অবাক হচ্ছো। তুমি আমাকে গরিব মনে করেছিলে?
থতমত খেয়ে যায় রাফি। কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না।
না মানে, ইয়ে…
লজ্জা কিছু নেই ভাইয়া। আমার চলাফেলায় তেমনই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।
কিন্তু এর কারণ কি? জানতে চায় রাফি।
আমার বাবা-মা আমাকে রুটিন করে দিয়েছেন। তারা বলেছেন, “শোন বাবা তাকি! তুমি যে ধনী কখনো এটা ভাববে না। তাহলে তোমার ভিতর অহংকার চলে আসবে। তুমি সপ্তাহে কোনো কোনো দিন গরিবরা যা খায় তাই খাবে, গরিবরা যা পরে তুমিও তাই পরবে। গরিবদের সাথে ওঠা-বসা করবে। তাহলে তুমি তাদের দুঃখ-কষ্ট বুঝতে পারবে। তুমি বুঝতে পারবে তারা কত কষ্ট করে জীবন ধারণ করে। তুমি তাদের মতো করে চললে তারাও তোমার সাথে সহজে মিশতে পারবে। তাদের দুঃখে সাহায্য করা তোমার জন্য সহজ হবে।” তাই আমি এভাবে চলাফেলা করি। আমার বন্ধুরা জানে আমি ধনী কিন্তু তাতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না। আমি সহজেই তাদের সাথে মিশতে পারি।
অবাক হয় রাফি। কেমন যেন লজ্জা লাগে নিজের কাছে। কি বলবে সে?
তোমার বাবা-মাও কি এমনই করেন? জানতে চায় রাফি।
হ্যাঁ, তারাও এমনই করেন।
রাফি কথা হারিয়ে ফেলে। নিজেকে নতুন করে চিনতে শুরু করে সে। নতুন করে চলার প্রেরণা পায়। আল্লাহর শুকর সে তাকি মতো একজন বন্ধু পেয়েছে।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment