এক.
উম্মে হানি বসে আছেন বাড়ির ছোট্ট আঙ্গিনায়। গল্প বলছেন, জীবনের গল্প। জীবনের গল্পে তো আনন্দ-বেদনার মিশেল থাকে, কিন্তু তার গল্পে আছে শুধু বেদনা, শুধু অশ্রু এবং শুধু রক্তের ঘ্রাণ। তাকে ঘিরে আছে সন্তানরা। দুইমেয়ে একছেলে। ছেলের নাম হানি।
‘১৯৭২ সালে আমরা থাকতাম এই ছোট্ট কুটিরেই। আমি, তোমাদের আব্বু-মাহমুদ আবু হাম্মাম এবং তোমরা। হানি’র বয়স যখন নয়মাস, তখনই আমাদের ঘরে ইহুদী সৈন্যরা হানা দিয়েছিলো। ওরা তো মানুষ নামের জন্তু। হিংস্রতায় জন্তুকেও ওরা হার মানায়। যে ঘরেই হানা দেয় সে ঘরেই তাণ্ডব চালায়। মুহূর্তেই সবকিছু তছনছ করে দেয়। ওরা ঢুকতেই তোমাদের আব্বু ওদেরকে বাধা দিলেন। রুখে দাঁড়ালেন। তখন একটা সৈন্য লোহার বাট দিয়ে তার মাথায় সজোরে আঘাত করলো। তিনি মারাত্মক আহত হলেন।’
থেমে গেলেন উম্মে হানি! দরদর করে অশ্রু পড়তে লাগলো! আঁচলচাপা দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন তিনি। আবার বলা শুরু করলেন- ‘আঘাতটা ছিলো প্রচণ্ড। সাথে সাথে তিনি পড়ে গেলেন! ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগলো। রক্তে সব ভেসে গেলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম। চিৎকার শুনে প্রতিবেশিরা ছুটে এলো। দ্রুত এ্যম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হলো। যে কামরাটায় তার চিকিৎসা চলছিলো, আমি নিথর দাঁড়িয়েছিলাম তার দরোজায়। মনে শঙ্কা ও আশঙ্কা- আর কি দেখা হবে না! আর কি কথা হবে না! আল্লাহ তুমি তাকে বাঁচাও! আল্লাহ তুমি সুস্থ করে তোলো! একটু পর ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। বললেন : ‘প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে।’
আমি অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝতে পারলাম না। একটু পর আবার দেখলাম ভদ্রলোকটি বেরিয়ে এলেন। তার অবস্থার ভাষা বলছিলো : ‘আপনার স্বামী চলে গেছেন!’
আমি আর সইতে পারলাম না। ভিতরটা হাহাকার করে উঠলো। এক ভয়াবহ শূন্যতায় ভরে গেলো। শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ইহুদীদেরকে অভিশাপ দিতে লাগলাম।’
মা বলে যাচ্ছিলেন। ছেলে-মেয়েরা শুনছিলো। মায়ের অশ্রু ও দুঃখের সাথে ওদের অশ্রু ও দুঃখও মিশে গেলো।
হানি তো তখন অনেক ছোট ছিলো। মাত্র ন’মাস। পরে বাবার কথা ও শুনেছে শুধু মায়ের মুখেই। কতোবার শুনেছে। শুনতে-শুনতে ইচ্ছে করেছে বাবাকে কাছে পেতে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে। বাবার কথা ভাবতে-ভাবতে এবং মায়ের কাছে শুনতে-শুনতে বাবার একটা ছবি গেঁথে গেছে ওর মনে। চোখ বন্ধ করলেই ও বাবাকে দেখতে পায়। বাবা যেনো ওর দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে হাসেন আর বলেন ‘হানি! বড় হও, মানুষ হও! মানুষের মতো মানুষ হও! ইহুদীদের মতো অমানুষ হয়ো না!’
হানি গরম নিঃশ্বাস ফেলে বাবাকে স্মরণ করে। মনে মনে বলে : ‘বাবা! একটু বলবে, কোন্ ইহুদীর বাচ্চাটা তোমাকে মেরেছিলো? আমি প্রতিশোধ নেবো! কঠিন প্রতিশোধ!’
হানি’র কচি হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়। পাথরকণার দিকে ওর দৃষ্টি চলে যায়। একেকটা পাথরকণাকে মনে হয় একেকটা বিধ্বংসী গোলা।
সব ফিলিস্তিনী শিশু-কিশোরের চোখেই এইসব পাথরকণা মূল্যবান। কেননা এগুলো দিয়ে ইহুদী সৈন্যদেরকে তাড়া করা যায়। পাথরকণার গুঁড়ি বৃষ্টিতে ‘সিক্ত হয়ে’ ওরা যখন পালিয়ে যায়, তখন মনে হয় একপাল নেড়িকুত্তা পালিয়ে যাচ্ছে ধাওয়া খেয়ে!
দুই.
কঠিন জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি উম্মে হানি। মাথার উপর আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ছায়া নেই। ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে হবে। আয়-রোজগারের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নিজের লেখাপড়া কিছুই করা হয় নি। পরাধীন ফিলিস্তিনে লেখাপড়া করা ক’জনের পক্ষে সম্ভব? সব জায়গায় ওঁৎ পেতে আছে ইহুদী সৈন্যরা। যখন তখন যেখানে সেখানে ঝেঁপে পড়ছে। এদের হিংস্র তাণ্ডবে ফিলিস্তিনীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বলতে কিছুই নেই। আজ এ মায়ের বুক খালি হলে কাল ও মায়ের বুক খালি হচ্ছে। অমানবিক নিষ্ঠুরতায় ইহুদীরা নিরপরাধ ফিলিস্তিনীদেরকে পাখির মতো গুলি করে করে মারছে। উম্মে হানি অসুস্থ ও আহত ফিলিস্তিনীদের সেবা করার জন্যে গাজার একটা হাসপাতালে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
তিন.
এভাবেই এই শহীদ পরিবারের চাকাটা আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগলো। মেয়েরা বড় হতে লাগলো। উম্মে হানি’র ‘স্বপ্ন’- হানিটাও বড় হতে লাগলো। এখন ও গাজা’র একটা মাদরাসায় পড়ে। মা দেখেন একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হানি মাদরাসায় যাচ্ছে আবার ক্লাস শেষে ফিরে আসছে। দেখতে কী ভালো লাগে! ছেলের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নের ভুবনটাকে বড় করেন। সেখানে সুন্দর সুন্দর আশা নির্মাণ করেন। তার স্বপ্ন একদিন বাস্তব হবে। হানি একদিন বড় হবে। লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে। কবরে বসে শান্তি পাবেন বাবা। দুনিয়ায় বসে চোখ জুড়াবেন মা।
হানি শিক্ষার প্রাথমিক স্তর শেষ করে দ্বিতীয় স্তরে উঠেছে। মা’র স্বপ্নের ভুবনটা আরেকটু বড় হয়। সেখানে সবুজ সবুজ কিশলয় দেখা দেয়! ডালে ডালে ফুলকলিরা ফোট ফোট হয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসে!
উম্মে হানি কল্পনায় এ-সব ভাবেন আর আনন্দে সাঁতার কাটতে থাকেন। হে আমার স্বপ্ন! কাছে এসো! বাস্তব হয়ে আলো ছড়াও! স্বাধীন ফিলিস্তিনের শামিয়ানার শীতল ছায়ায় আমাদেরকে জায়গা দাও!
চার.
হানি সমুদ্রঘেঁষা তাঁবু পল্লী’র ছোট ছোট গলিপথে ঘুরে বেড়ায়। এখানে এক দু’জনের বেশি একসঙ্গে চলাই মুশকিল। একেবারে ঘুপচি গলি। ঘিঞ্জি এলাকা। তবুও এ-সব এখন গা-সওয়া গেছে। চোখ মেলেই তো এ-সব দেখে চলেছে। এর একেবারে কাছেই সমুদ্র তীর। ওখানেই শিশুরা ছুটে বেড়ায়। দৌড়াদৌড়ি করে। নানা রকমের খেলা নিয়ে মেতে ওঠে। ওদের কাছে সবচে’ প্রিয় খেলাটা হলো—- গাজা’র সমুদ্র তীরের বিস্তীর্ণ বালির বুকে ঘর বানানো। এই খেলনা ঘরকে ওরা ‘এই প্রাসাদ’ ‘সেই প্রাসাদ’ নাম দিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসে। সে হাসিতে যেনো রুপালি আভা ছড়িয়ে দেয় সমুদ্রের জলরাশি। তাঁবুপল্লীর এই বঞ্চিত শিশুরা এ-সব খেলনা প্রাসাদে কী খুঁজে ফিরে? হারানো ফিলিস্তিন? মনে হয়; তাঁবুপল্লীর ছোট্ট ঘরে থাকতে থাকতে বিরক্তি ধরে গেছে ওদের। তাই বালির বুকে বড় বড় প্রাসাদ গড়ে ওরা মনের আশ মেটায়। বালির বুকে এই ‘প্রাসাদ প্রাসাদ’ খেলা হানি’রও খুব প্রিয়। বন্ধুদের সাথে এখানে ওর অনেক মধুর সময় কাটে।
পাঁচ.
একদিন হানি বন্ধুদের সাথে বসে আছে। চুপচাপ, কোনো কথা বলছে না। নীরব তাকিয়ে আছে সমুদ্রের নিস্তরঙ্গ জলরাশির দিকে। একবন্ধু হানিকে মৃদু ধাক্কা দিলো। বললো : অমন গম্ভীর হয়ে কী ভাবছো, হানি?
হানি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো : শিশুদের চোখের দিকে আমি তাকাতে পারি না! ওদের চোখে যেনো হাজার হাজার দুঃখ-পাখি ডিম পেড়ে রেখে গেছে। তাই ওরা তাকালেই যেনো সামনে দেখতে পায় দুঃখ। ওরা ঘুমালেও স্বপ্নে দেখে কেবল দুঃখ। ওদের হাসিও দুঃখঘেরা। ওদের কণ্ঠও কান্নাভেজা। বর্তমান ওদের দুঃখঘেরা, ভবিষ্যতও ওদের দুঃখে-ছাওয়া। দুঃখ যেনো ওদের উত্তরাধিকার। বাবার কাছ থেকে ছেলে পেয়েছে। ছেলের কাছ থেকে ছেলে পাবে, নাতিরা পাবে। আমরা কি এভাবেই দুঃখের কাছে পরাজিত হবো, হেরে যাবো?
এক বন্ধু জানতে চাইলো : হানি! বলেছো তো আমাদের মনের কথাটিই। কিন্তু এ থেকে উত্তরণের পথ কী? এ-সবের সমাধান কী? সমাধান হলো আরো রক্ত! বুকের তাজা রক্ত!! রক্ত ছাড়া মুক্তি মিলবে না! কোনোদিনই ফিলিস্তিন আযাদ হবে না। গাজা নামের এই বড় কারাগারটাতেই আমাদেরকে বন্দি থাকতে হবে। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর।
কেনো, ‘ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা’ তো কাজ করছেই!
রাখো তোমার .. সংস্থা! তুমি ভালো করেই জানো, সংস্থাটা এখন আর মুক্তি সংস্থা নেই। এখন শুধু আরাম-আয়েশ চায়। বিলাসিতায় -এর দেহ এখন ভারি। চলতেই পারছে না। আজ এ চুক্তি। কাল ও চুক্তি! এ-সব চুক্তি করে কী লাভ? তাও আবার এই বজ্জাত ইহুীদের সাথে? ওরা কি চুক্তিতে বিশ্বাস করে? চুক্তির আড়ালে ওরা লুকিয়ে রাখে শুধুই অবিশ্বাস আর দুশমনি।
ছয়.
১৮.০৩.৮৮ তারিখে হামাস-এর পক্ষ থেকে একটি ঘোষণা ছাপা হয় পত্রিকায়। সেখানে বলা হয়- ‘আজ হৃদয়ে রক্তক্ষরণের দিন। এইদিনে উত্তর গাজা’র একটি মসজিদে ঘৃণ্য অভিযান চালিয়েছিলো ইহুদী সৈন্যরা। নষ্ট করেছিলো মসজিদের পবিত্রতা। আজ শুক্রবার উক্ত মসজিদে জুমা আদায়ের পর এক প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত মিছিলে অংশগ্রহণ করে আওয়াজ তুলুন- হে অভিশপ্ত ইহুদীরা! আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ এখনো বন্ধ হয় নি। তোমাদের অপকর্ম আমরা ভুলি নি! কোনোদিন ভুলবো না!’
হানিও পড়লো সংবাদটা। পড়ে নিজের ভিতরে অদ্ভুত এক আলোড়ন অনুভব করলো। ওর মন থেকে উচ্চারিত হলো- হানি! তোমাকেও যেতে হবে! মসজিদের সেই ভাঙা দেয়াল তোমাকে ডাকছে! ওখানে লুটিয়ে পড়া রক্তাক্ত শহীদান তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, যাবে না?!
হানি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। ও এ-আহ্বানে সাড়া দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে! জুমা’র আগে ভালো করে গোসল করে! তারপর মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে!
ষোল বছরের হানি এগিয়ে চলেছে মজলুম মসজিদের দিকে- অপমানের প্রতিবাদ জানাতে। ইহুদীদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্ষোভ বুকে নিয়ে। এই মুহূর্তে চোখে ভাসছে বাবা’র ছবিটা। বাবা যেনো তার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার এই পথচলাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তার সামনে আরো ভাসছে জান্নাতের ছবি! শহীদরা তো জান্নাতে সবুজপাখি হয়ে উড়ে বেড়ায়! ও কি পারবে জান্নাতের সবুজপাখি হতে! আরেকটা ছবি এখন ভাসছে ওর চোখের সামনে। মায়ের ছবি! কী কষ্ট করেন মা সারাটা দিন হাসপাতালে- শুধু ওদের একটু আরামের জন্যে! হানির দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে!
সাত.
অনেক বড় মিছিল। লোকে লোকারণ্য। আজকের এ মিছিলকে ঘিরে দখলদাররা ছিলো ভীষণ সতর্ক। ওরা মসজিদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিলো, প্রচুর সংখ্যায়। তবু দামাল ফিলিস্তিনীদের চোখের দিকে তাকাতে ওরা ভয় পাচ্ছিলো। কী জ্বলন্ত দৃষ্টি! যেনো অগ্নিগোলা! সংঘর্ষের প্রবল আশঙ্কা করা হচ্ছিলো। উভয় দিক থেকেই। শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ বেধেই গেলো। হানি ছিলো একেবারে সামনে। বুক চিতিয়ে বীরের মতো সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো। সশস্ত্র ইহুদী সৈন্যদেরকে একদম ভয় পাচ্ছিলো না ও। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি তুলে হানি সবাইকে সামনে বাড়তে বলছিলো। ওর চেহারা লালচে দেখাচ্ছিলো। যেনো শাহাদতের ‘লাল’ এসে ভিড় করেছিলো ওর সারা মুখাবয়বে! ইহুদীরা বিপদ টের পেয়ে বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করতে লাগলো। প্রথমে এলোপাথাড়ি তারপর সরাসরি মিছিলে! ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি আর গোলাগুলির শব্দে গাজা’র আকাশ বাতাস কেঁপে উঠতে লাগলো বারবার!
আট.
হঠাৎ হানি গুলিবিদ্ধ হলো! গুরুতর আহত হলো! রক্তে ভেসে গেলো দেহ! সবাই ধরাধরি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। হানি’র দিকে এগিয়ে আসছিলো কি শাহাদতের ভাগ্য? পূরণ হচ্ছে কি ওর সবুজপাখি হওয়ার সবুজ স্বপ্ন?
খবর পেয়ে মা ছুটে এলেন হানি’র কাছে। কেঁদে উঠলেন ডুকরে ডুকরে! ডাক্তার তাকে আশ্বাসবাণী শোনালেন। বললেন: সেরে ওঠবে, চিন্তা করবেন না!
ডাক্তার ভিতরে চলে গেলেন! একটু পর আবার ফিরে এলেন! বললেন: হানি এখন শহীদ! আপনি শহীদের মা!
একই দৃশ্য! আগে বাবা, এখন ছেলে!!
হে আল্লাহ! উম্মে হানিকে ধৈর্য দাও!
নয়.
উম্মে হানি আবার শোকে শোকে পাথর হয়ে গেলেন। এক শহীদজননী হিসাবে আত্মিক তৃপ্তিটুকু ছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনো অবলম্বন রইলো না! হানি’র বন্ধুরা এর মধ্যেই ওকে দ্রুত হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করলো। ইহুদীরা হাসপাতালে চলে আসতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। অপমান করতে পারে হানি’র লাশ।
কিছুক্ষণের ভিতরেই তারা হানিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো সমুদ্র তীরের তাঁবুপল্লীতে। কিন্তু জালিমরা ততোক্ষণে জেনে ফেলেছে হানি’র সংবাদ। তারা এসে তাঁবুপল্লী ঘেরাও করে ফেললো। আবার শুরু হলো ভয়াবহ লড়াই। হানি সাধারণ কোনো যুবক ছিলো না। ও ছিলো ইহুদীদের মাথা ব্যথা। তাই ওকে ঘিরে এই তাণ্ডব। ওরা চেয়েছিলো হানিকে হত্যা করতে। পেরেছে। কিন্তু তার লাশকে অসম্মান করতে পারে নি! ফিলিস্তিনের দামালরা তার লাশের ইযযত রক্ষা করেছে!
ইহুদীরা কয়জনকে হত্যা করবে? লক্ষ লক্ষ তরুণ যুবক শহীদ হতে প্রস্তুত! ইহুদীদের চোখে যা হত্যা, হানিসহ সব ফিলিস্তিনীর চোখেই তা গরবের মৃত্যু, শহিদী মৃত্যু। এ মৃত্যুর জন্যে ফিলিস্তিনের প্রতিটি মুসলমানই ইহুদীদের সাথে লড়াই করে জীবন বিলাতে গর্ববোধ করে। এ যে শহিদী মৃত্যু! এ শহিদী মৃত্যু কী দামী এবং তা এই যুবকদের কাছে কী কাম্য- তা কী করে বুঝবে এই অভিশপ্ত ইহুদীরা? বানর শূকরের এই উত্তরসুরিরা!
দশ.
হ্যাঁ, এখান থেকেই শুরু হয়েছিলো ফিলিস্তিনের প্রথম ইন্তেফাদা। এ ইন্তেফাদার ঢেউয়ে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল কবেই ভেসে যেতো। কিন্তু দেশী-বিদেশী কতিপয় গাদ্দারের কারণে তা আজো সম্ভব হয় নি। এই ইন্তেফাদা আজো চলছে। ফিলিস্তিনের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিতা না হওয়া পর্যন্ত এ ইন্তেফাদা বন্ধ হবে না। এ ইন্তেফাদা বন্ধ না হওয়ার আরেকটা কারণ হলো, ফিলিস্তিনীরা রক্ত ঢালতে ভয় পায় না। এক তরুণ শহীদ হলে হাজার তরুণ এগিয়ে আসে। এ জন্যে সাতষট্টি বছরের ইতিহাসে বারবার চেষ্টা করেও ইহুদীরা ফিলিস্তিনের দামাল ছেলেদেরকে কাবু করতে পারে নি। বিধ্বংসী টেংক-কামান ও সাঁজোয়া যান নিয়ে কতোবারই তো ওরা এদের উপর হামলে পড়েছে! বারবারই মনে হয়েছিলো— এবার বুঝি হামাসের কোমর ভেঙে পড়েছে! ফিলিস্তিনটা বুঝি শেষ হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু না, ফিলিস্তিন শেষ হয় নি! প্রতিবারই ফিলিস্তিন জ্বলে উঠেছে! প্রতিবারই ছোট ছোট পাথরকণা আর সেকেলে বন্দুক রাইফেলের ধাওয়া খেয়ে ইহুদীরা পালিয়েছে!
এগার.
উম্মে হানি একসময় ছেলের শোক কাটিয়ে ওঠেন। আবার ফিরে আসেন স্বাভাবিকভাবে কাজের ময়দানে-হাসপাতালে। সেবা করে যান অসুস্থ ও আহত ফিলিস্তিনীদের। এরাই এখন তার স্বামী-সন্তান। এখানে বসে বসেই উম্মে হানি স্বপ্ন দেখেন স্বাধীন ফিলিস্তিনের। হাসপাতালে আসা-যাওয়ার পথে যখনই কোনো মিছিল তার চোখে পড়ে, তখন নিজের অজান্তেই তিনি থমকে দাঁড়ান। মিছিলের ভিড়ে তিনি খুঁজে ফিরেন হানিকে! ঝাঁঝালো মিছিলের মুখে যখন ভেসে আসে গগনবিদারি শ্লোগান-
الله غايتنا …..والرسول قدوتنا
والقران دستورنا
والجهاد سبيلنا
والموت في سبيل الله اسمى امانينا
আল্লাহ আমাদের লক্ষ্য
রাসূল আমাদের আদর্শ
কুরআন আমাদের সংবিধান
জিহাদ আমাদের পথ
আল্লাহর পথে জীবন বিলিয়ে দেয়া আমাদের শ্রেষ্ঠ চাওয়া!
তখন উম্মে হানি’র চোখে নেমে আসে ‘শ্রাবণধারা’! অনেকক্ষণ ধরে তিনি অপলক তাকিয়ে থাকেন মিছিলটার দিকে! মনে হয়- এরা সবাই যেনো হানি!!