শান্তির পথে নেমে

শান্তির পথে নেমে

১.
নভেম্বর শুরু সবে। গ্রামের শিশির ভেজা হালকা গা-কাঁপনো বাতাস এখন শহরে না পৌঁছালেও শীত শীত ভাবটা বেশ ছুঁয়ে যায়। সারাদিনে কর্মক্লান্তি কিছুটা হলেও নাড়া দেয় সন্ধ্যা গড়ালেই। এশার পরে তাই তো একটু উষ্ণতা খোঁজে মন। মনের টানে তাই এশার পড়ে প্রায়ই আয়েশি আড্ডা জমে হাস্যরসিক রহিম ভাইয়ের দোকানে। নিত্যই নামাজের সঙ্গী মাসুম ভাইকে সময়ের চাহিদায় আড্ডায় পেলেও প্রায়ই তিনি নিজের দোকান গুটিয়ে বাসার তাড়ায় ব্যস্ত থাকেন। বন্ধু নাহিয়ান এসে যোগ দেয় দিন জুড়ে অফিস করে লাল চোখে।

রাত তখন দশটা প্রায়। শহরের আলোর কিরণে সন্ধ্যা বলেই মনে হয়। এশা পড়লাম কিছুক্ষণ মাত্র। শীতের রাতে সাড়ে সাতটায় এশা হয়ে গেলো। বাসার পাশের মাদরাসাসংযুক্ত মসজিদ হওয়াতে একটু রাত গড়িয়েই এশা হয়। উত্তরের হাওয়া কিছুটা টানটান। টি-শার্টে ঠাণ্ডা কিছুটা অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মসজিদ থেকে বের হতেই মন টানলো ধোঁয়াওঠা আদা-চায়ে। একটু হেঁটেই রহিম ভাইয়ের দোকান, দৃষ্টি বুলিয়ে পরিচিত মুখের অভাবে পড়লাম। নির্ধারিত জায়গা ছেড়ে গিয়ে বসলাম রহিম ভাইয়ের পাশেই। রাব্বির দিকে চেয়ে মুচকি হাসতেই সে লেবুছাড়া চা বানাতে গেলো। ওহ! বলতে ভুলে গেছি। যদিও রাব্বি চায়ের উস্তাদ, অল্প বয়সে কথায়ও সে মজার স্বাদ!

চা হাতে আয়েশি চুমুক দিলাম। আবাসিকের দোকান হওয়ায় রাতের আড্ডায় মানুষ কম, তবুও ভীড়টা রাস্তার পাশের কল্যাণে। টাকা গোনার মাঝে সাঝে খুনসুটি আলাপ হচ্ছে রহিম ভাইয়ের সাথে। পাশে আসা চটপটি দোকানের টক থেকে শুরু করে শীতকালে ডিমসিদ্ধ বিক্রি; নানান আলোচনা হচ্ছে বেশ। মাঝে এক শক্ত প্রশ্নে কিছুটা উদাসী হলো রহিম ভাই। নামাজ পড়া না হওয়ার কারণ বলতে গিয়ে কিছু বিমর্ষও হলো সে। অনেকটা সূক্ষ্ম দুঃখবোধও জাগলো মুখের বলিরেখায়।

২.
নানাকথায় চায়েরকাপ খালি হতে লাগলো। গাল-গল্পে সময় বেশ গড়াচ্ছিলো। আলোচনা দাবার ঘুঁটির মত ক্ষণে ক্ষণে ঘর পাল্টাচ্ছিলো। নানান ঘর ঘুরে আলোচনায় আসলো মহান স্রষ্টার অসীম রহস্য আর রহমতের দৃষ্টান্তের উজ্জ্বলতা। গল্পের শব্দে বর্ণে বর্ণে বর্ণনা হতে লাগলো উপরওয়ালার উদারতা। গল্পের বিষয় ভূমিকায় তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো রহিম ভাইয়ের মুখে। নিষ্পাপ হেসে বলতে শুরু করলো একমুগ্ধতার উপখ্যান। যার প্রতিটি শব্দে মিশেছিলো মহান কারিগরের বিমুগ্ধ ভালোবাসা। গল্পের আদিপ্রান্ত বর্নণা শুনা যাক রহিম ভাইয়ের নিজস্বতয়….

‘গল্পটা বেশ কিছুটা পেছনের সময়ের। তখন গরমকাল। দোকানটা তখনও আমার ছিলো না। চাকরি করতাম মোটামুটির পর্যায়ে। থাকতাম তখন উত্তর হালিশহরের একআবাসিকে। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে বেশ সন্ধ্যাই হয়ে যেতো। কখনোবা একেবারে তাড়াহুড়ায় মাগরীব ধরতাম শেষ কাতারে। কাজেরক্লান্তি বেশ আপন করলেও কিছুটা সময় কাটাতাম পরিচিত আড্ডায়। বয়সের গুরুজনদের সাথে ভাবছিলো আমার একটু বেশি। বয়সে আমি ছিলাম সবচেয়ে নবীন। নিজের অজান্তেই হৃদ্যতা গড়ে সংখ্যার অমিলে। সময়ের সম্মুখ গড়ানে ফিকে হয়ে যায় এ ব্যবধান। গড়ে উঠে শক্ত একভালোবাসার ঘর। এ ঘরে দিনের কিছুটা হলেও দিতে হয়! মনের জন্য, মায়ার জন্য।

আমাদের ভালোবাসার এ ঘরের অন্যতম একস্তম্ভ ছিলো ফখরুল সাহেব। দাড়ি চুলে বয়সের শুভ্রতা ছড়ালেও শরীর ছিলো বেশ শক্তসামর্থ্য। স্রষ্টার প্রতি একাগ্রতায় জীবন কাটছিলো তার। দুইমেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসারে চাহিদা মিটলেও উচ্চাশা ছিলো অনেক। সময়ের বহতায় ফখরুল সাহেবও ছিলেন বেশ মুক্ত। এলাকার প্রিয়মুখ হিসাবে তিনি ছিলেন অনেক উপরে। প্রভাবে বেশ আদর্শিকই ছিলো তার ছোট্টপরিবার। বয়সের চাহিদায় মেয়েরা ছিলো বিবাহ উপযুক্ত। আল্লাহর রাস্তায় সময় কাটানো ফখরুল সাহেব তাই বেশ আন্তরিক অপেক্ষায় ছিলেন মেয়েদের একটা ভালো সংসারের। ফলে অনেকদিন ধরে দ্বীন প্রচারে বের হবো হবো করেও হচ্ছিল না। সমবয়সী অনেকে তখন নানাদলে ভাগহয়ে আল্লাহর বাণী প্রচার করছিলেন। দ্বীনের বাণী পৌঁছে দিচ্ছিলেন আমজনতার মন-মস্তিষ্কে। প্রবল ইচ্ছে শক্তিকে শক্ত করে ফখরুল সাহেব অপেক্ষায় ছিলেন মেয়ের দায়িত্ব স্থানান্তরে। সময়ে প্রবহমান স্রোত গড়াচ্ছিলো। ভালো সংবাদের পায়রার খোঁজ মিলছিলো না। বিশ্বাসী ফখরুল তবুও ছিলেন বেশ আস্থাশীল। দৃঢ় বিশ্বাসে ফখরুল ছিলেন স্রষ্টার মুখাপেক্ষী। তবে সময় ছিলো বেশ কঠিন। অনেক প্রহরের অবশেষে গরমের একক্লান্ত বিকালে ফখরুল সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন তার মনোভাবনা পুরণের।

প্রস্তুতির সময়টুকু বেশদ্রুত কাটলো ফখরুল সাহেবের। এলাকার মানুষ থেকে বিদায় তো নিলেনই সাথে পরিচিত ব্যক্তিবর্গের হাতে তুলে দিলেন দুইমেয়ের ভালো মন্দের অভিভাবকত্ব। প্রিয় ফখরুলকে নিশ্চিন্ত করলেন তারা। পরিশেষে নির্মল হাসিতে তাবলীগের পথে ফখরুল সাহেব।

সময়ের পরিক্রমায় দিন গড়িয়ে মাস। ফখরুল সাহেবের স্মৃতি কিছুটা কমে এসেছে। এক সন্ধ্যারাত। এশা শেষে ছিল মাত্র কয়েকজন। নিময় ভেঙ্গে অপরিচিতর সালাম। কুশলবিনিময়ে কিছুটা জানা হলো তাদের। আলাপে আলাপে আনন্দ সংবাদ এলো। খোঁজ খবরের মাঝে তারা জানলো ফখরুল সাহেব ও তার মেয়েদের কথা। আমরাও জানালাম বেশ আবেগে, আনন্দে।

মাঝে বেশ কয়েকদিন গেলো। ব্যস্ত ছিলাম খুবই। চাকরিতে চাপ গেলো। সম্ভবত সেদিন ছিলো শুক্রবার। ছুটিতে বাসায় ছিলাম। জুম্মার পর বসলো স্থানীয়রা। অল্প পরে জানতে পারলাম এর কারণ। ওই দিনের খোঁজ নেওয়া মানুষগুলো উঠেপড়ে লেগেছে ফখরুল সাহেবের মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে। নানা অযুহাতে সবাই মিলে বাসায় গেলো ফখরুল সাহেবের। সবার বিচার-বিশ্লেষণে রাজি হলো ফখরুল সাহেবের স্ত্রী। অবেশেষে পরম করুণাময়ের অশেষ রহমতে ফখরুল সাহেবের বড়কন্যা ফাতেমার বিয়ে হয়ে গেলো।

এদিকে দ্বীনের দাওয়াত আর সত্যের আলো জ্বালতে ফখরুল সাহেব সময় কাটাতে লাগলেন মানুষের মনের দুয়ারে দুয়ারে। ইসলামের ইতিকথায় কড়া নাড়তে লাগলেন আমজনতার বদ্ধ বিবেকে। অপর দিকে ফাতেমা তখন নতুন বৌ-এর লজ্জা কাটিয়ে সংসার কর্মে ব্যস্ত। স্বামীসহ শশুড় বাড়িতে ফজর থেকে যে কর্ম ব্যস্ততা শুরু হয়, মধ্যরাতে জায়নামাজে চোখের জলে তা হয়তো কিছুটা শান্ত হয়। সময়ের অল্পতেই মন জয় করে প্রিয় হিসাবে সর্বজনীন হলেন ফাতেমা। পারিবারিক শিক্ষার আলো আর ধর্মের নূর মিলে উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকায় পরিণত হলো সে। ঘরে থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন পরিচর্যায় উদ্ভাসিত ফাতেমা।

এর মধ্যেই প্রবাস ফেরত খালাতো ভাই এলো ফাতেমার স্বামীর। প্রিয় ফাতেমা ভাবীর বোনকে জীবনে সাথী হিসাবে চাই। তবে ফখরুল সাহেবের অনুপস্থিতি অমতের কারণ হিসাবে আসলো। তবুও প্রবল আগ্রহের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত ফারহানারও বিয়েটা হয়ে গেলো। করুময়ের অসীম দয়ায় নতুন জীবনে পা রাখলো ফখরুল সাহেবের ছোটকন্যা। সত্য আর সুন্দরের স্নিগ্ধ সুভাস ছড়িয়ে ফারহানাও হলো সবার প্রিয়।

৩.
চিল্লা শেষে বাড়িতে ফিরলেন ফখরুল সাহেব। তার আগমনে খুশির লহর ছুটলো এলাকায়। সবার আন্তরিক মোবারকবাদ আর মহব্বতে মন ভরে গেলো তার। ঘরের প্রিয় মুখগুলোর প্রশান্তির আশায় দ্রুতই পা চালালেন তিনি। সালামের বিনিময় খোঁজ করলেন প্রিয় দুইমুখ ফাতেমা আর ফারহানার। উত্তরে পেলেন হাসিমুখ। ঘটে যাওয়া পেছনের কথাগুলো যখন ফখরুল সাহেবের কানে প্রবেশ করলো তখন মুখ দিয়ে সর্বপ্রথম শব্দ বের হলো আলহামদুলিল্লাহ। অযু করে দুই রকাত নফল আদায় করে যখন তিনি স্ত্রীর সামনে বসলেন। তখন চেহারায় পূর্ণ আনন্দ খেলা করছিলো। মহান কারিগরের অপার দয়ায় ফখরুল সাহেব মুগ্ধ হয়ে আরো বেশি করে প্রভুর পথে শান্তি খোঁজায় মগ্ন হতে মন বাঁধলেন।

Share on facebook
ফেইসবুক
Share on twitter
টুইটার

Leave a Comment

অন্যান্য